সম্পাদকীয় ১

ধর্মের গরু

গ রু লইয়া গোটা দেশে কিছু কাল ধরিয়া যাহা চলিতেছে, তাহাতে দেশ শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছাইবে, তাহা অনুমান করিবার জন্য ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করিলেই চলিবে। ভারতে এমন আগেও ঘটিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

গ রু লইয়া গোটা দেশে কিছু কাল ধরিয়া যাহা চলিতেছে, তাহাতে দেশ শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছাইবে, তাহা অনুমান করিবার জন্য ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করিলেই চলিবে। ভারতে এমন আগেও ঘটিয়াছে। প্রচারের অতি আধিক্যে কোনও একটি বিশেষ প্রতীকের ধর্ম-অনুষঙ্গ ছাপাইয়া রাজনৈতিক অনুষঙ্গটি অনেক গুরুতর হইয়াছে, এবং তাহাকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের মূল বিন্দু করিয়া তোলা হইয়াছে। সংঘর্ষ শেষাবধি সমাজের আগাপাস্তলা সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈয়ারি করিয়া যুযুধান হিংস্রতার সামনে সাধারণ মানুষকে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। তাহাও পরিচিত ইতিহাস। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকের সেই পরিচিত ইতিহাস দেখাইয়া দেয়, প্রায় সওয়া শত বৎসর যাবৎ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তৈরির খেলায় গরু একটি অত্যন্ত ‘কার্যকর’ প্রতীক। দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে আর্যসমাজী-রা প্রথম গরু লইয়া এই খেলা শুরু করিয়াছিল। ১৯২৫ সালের পর সঙ্ঘ পরিবারের দৌলতে উত্তর ভারতে একের পর এক দাঙ্গার কারণ হইয়াছে গরু। গো-রক্ষা সমিতি ঐতিহাসিক ভাবেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান বাহক। সেই রাজনীতির দাম দেশকে কী কঠিন মূল্যে চুকাইতে হইয়াছিল, তাহার যন্ত্রণা ও ভয় বোধ হয় এখনকার রাজনৈতিক নেতৃবাহিনীর মানসলোকে স্থান করিয়া উঠিতে পারে নাই। তাই একবিংশ শতকের ভারতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, হয়তো আবার সেই ভয়ংকর ভবিতব্যের দিকে হাঁটিবার আহ্বান। ইতিহাস যেহেতু কেবল তাহার কৌশলী অপপ্রয়োগ ছাড়া এই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে প্রাসঙ্গিক নহে, তাহারা ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণের কথা ভাবিবেই বা কেন?

Advertisement

একটি কথা এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট করা দরকার। হিন্দুত্ববাদীরা যাহাই বলুন, হিন্দুমাত্রেই হয়তো জানেন যে, গরু কিংবা ‘গো-মাতা’ কোনও ধর্মীয় জীব নহে। হিন্দু সংস্কৃতির কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাহার বিশেষ মূল্য থাকিলেও হিন্দু ধর্মের সঙ্গে নাই, কোনও কালেই ছিল না। হিন্দু সমাজের কোনও কোনও অংশে গো-মাংস খাইবার প্রচলনও যে ছিল, আজকের সমাজ হইতে দূর প্রাচীন কালের বৈদিক সমাজ পর্যন্ত জীবনধারা, এবং দলিত কিংবা উত্তর-পূর্ব ভারতের সামাজিক অভ্যাস তাহা প্রমাণ করে। এই পরিস্থিতিতে যে গরুকে কেবলই মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দুত্বের প্রতীক হিসাবে তুলিয়া ধরা হইতেছে, তাহাতেই বোঝা যায় যে, গরু কোনও ধর্মীয় জীব নহে, রাজনৈতিক জীব। তাহার যাহা কিছু রক্ষা ও সেবা— সবই রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক, ধর্মীয় সন্ধির স্থান এখানে নাই। সুতরাং, পরধর্মবিদ্বেষ যে সমস্ত হিন্দুদের ধর্মাচরণের প্রধান অঙ্গ নহে, তাঁহাদের বোঝা জরুরি যে গরুকে কেবল একটি সমাজ-বিভাজিকা প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করিবার এই খেলাটির সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের কোনও সম্বন্ধ নাই।

ধর্ম হইতে ধর্ম-রাজনীতিকে আলাদা করিবার কাজে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজ সকলের আগে চলিলে ভাল। ঐতিহাসিক ভাবে হিন্দুত্ব প্রতীক-বাদ বা বিভাজক রাজনীতি উত্তর ভারতে যেমন প্রবল আকার ধারণ করিয়াছিল, বাংলায় গো-রক্ষা আন্দোলন, আর্য সমাজী উত্তেজনা স্থানীয় স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকিয়াছিল। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সাক্ষী বলিয়াই এই অঞ্চল যে প্রবল সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের লীলাভূমি, এ তথ্য এখনও ইতিহাসে স্থির-প্রতিষ্ঠিত নহে। এ রাজ্যে গো-সুমারি কিংবা গো-রক্ষা লইয়া বাড়াবাড়ি আটকাইবার যে প্রয়াস, তাহাকে মুসলিম তোষণ হিসাবে না দেখিয়া বরং এক বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও সামাজিক দায় পালন হিসাবে দেখাটাই জরুরি। দরিদ্র মুসলিম কিংবা প্রান্তিক হিন্দু গোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসের ওপর আক্রমণ, আসলে বর্ণ-হিন্দুর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া কিছু নহে। বাঙালি সমাজ মুক্তবুদ্ধির উপাসক হিসাবে গোটা দেশে পরিচিত। ঐতিহ্য ধরিয়া রাখিবার দায় বর্তমান বাঙালি প্রজন্মের।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন