সমঝদার বিক্রেতারা হারিয়ে যাচ্ছেন

বই চেনার দিন শেষ

বলা বাহুল্য, এই ফোন তো আর ছাড়া যায় না। আর এন যখন বলছেন, ঘোড়ার মুখের খবর। উনি জানেন, কার কী বইয়ে আগ্রহ। তেমন বই হাতে এলেই খবর পাঠাবেন। আগে তো বইমেলায় অন্যতম দুর্লভ বইয়ের ভাণ্ডার ছিল আর এন ভট্টাচার্যের স্টল।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১৫
Share:

আবার অচেনা নম্বর থেকে ফোন। একেই পেশাগত কারণে ফোনের জ্বালায় জেরবার, তার উপর অচেনা নম্বর হলে আর ধরতেই ইচ্ছে করে না। তবু ধরলাম। ‘‘আর এন ভট্‌চায বলছি। কয়েকটা আর্লি প্রিন্টের বাংলা বই এসেছে। কাঠখোদাই ছবিও আছে তাতে। কবে পাঠাব?’’

Advertisement

বলা বাহুল্য, এই ফোন তো আর ছাড়া যায় না। আর এন যখন বলছেন, ঘোড়ার মুখের খবর। উনি জানেন, কার কী বইয়ে আগ্রহ। তেমন বই হাতে এলেই খবর পাঠাবেন। আগে তো বইমেলায় অন্যতম দুর্লভ বইয়ের ভাণ্ডার ছিল আর এন ভট্টাচার্যের স্টল। পারিবারিক ও ব্যবসায়িক নানা দুর্যোগের পর কয়েক বছর আর বইমেলায় যেতেন না, ছেলেদের দিয়ে বই পাঠাতেন পুরনো গ্রাহকদের কাছে। দুষ্প্রাপ্য শিল্পগ্রন্থ (পুরনো বইয়ের কারবারিদের ভাষায় ‘আর্টের বই’), আঞ্চলিক ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, জীবনী— কত কী যে পেয়েছি আর এন-এর কাছে, তার তালিকা করা দুঃসাধ্য। দুর্লভ বাংলা-ইংরেজি-সংস্কৃত বইয়ের হদিস ছিল নখদর্পণে। নানা রকম নম্বর থেকে ফোন করতেন, তাই মাঝে মাঝে বুঝতে না পেরে ধরতাম না। রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আর ফোন করবেন না। মাত্র ষাট বছর বয়সে হঠাৎই চলে গেলেন। কলকাতায় পুরনো বইয়ের ব্যবসাকে যাঁরা খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছিলেন, বোধ হয় তাঁদের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি ছিলেন আর এন।

প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। কল্যাণী দত্ত যে সব পুরনো বইয়ের বিক্রেতাদের কথা লিখেছেন, তাঁদের জমানা অন্য রকম ছিল। সে কালে পুরনো পারিবারিক সংগ্রহের সূত্রে ভাল ভাল বই পুরনো বইয়ের বাজারে যথেষ্ট আসত। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের সমঝদার বিক্রেতাদের কথা যত্ন করে লিখে গিয়েছেন কল্যাণী দত্ত। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, সুকুমার সেন, নির্মলকুমার বসু— এঁরা কলেজ স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরেই তাঁদের অমূল্য বইসংগ্রহ তৈরি করেছিলেন। ছিলেন বারিদবরণ মুখোপাধ্যায়ের মতো ‘পাড়ার লোক’— দু’বেলা কলেজ স্ট্রিটের বইবাজারে ঘুরে না গেলে যাঁর ঘুম হত না। একেবারে অন্য প্রান্তে ছিল নির্মল কুমারের ‘কুমার্স’, যেখানে বিলেতের নিলামঘর থেকে সরাসরি বই আসত! রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লিখে গিয়েছেন জোড়াগির্জের নির্মল কুমারের কথা। কিন্তু মোটের উপর সত্তর দশক থেকেই পুরনো বইব্যবসার চেহারা-চরিত্র বদলাতে শুরু করল। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে স্থায়ী দোকানের মাধ্যমে আগ্রহী ক্রেতার হাতে বই পৌঁছে দিতে উদ্যোগী একাধিক চরিত্রের দেখা মিলতে লাগল। শুধু যে শহরের ফুটপাতই এঁদের বই সংগ্রহের উৎস ছিল এমন নয়। শহরে ও জেলায় পুরনো বাড়ির সংগ্রহ, বনেদি সংগ্রাহকের অনাগ্রহী কি অযোগ্য উত্তরপুরুষের বিক্রি করে দেওয়া বই, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাড়ার লাইব্রেরির বই, স্কুল কলেজ, নানা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির বাতিল বই, এমনকি কখনও-সখনও চালু লাইব্রেরির বইও নানা হাত ঘুরে পৌঁছে যেত এ সব দোকানে।

Advertisement

পুরনো বই সংগ্রহের পদ্ধতি মোটের উপর একই ধরনের হলেও বই বিক্রির তরিকা সকলের মোটেই এক রকম ছিল না। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের যোগাযোগ সুবিস্তৃত ছিল নানা মহলে, রসদদার ক্রেতার অভাব ছিল না। বাছাই বই বাছাই ক্রেতার কাছে যথাসময়ে পৌঁছে যেত। কিন্তু এমনিতে তাঁর ‘সুবর্ণরেখা’ ছিল সবার জন্য অবারিত। প্রথম দেখার গল্পটা বলি।

স্কুলজীবনটা কলেজ স্ট্রিটেই কেটেছে বলে ফুটপাতের দোকানগুলোর সঙ্গে ছিল আবাল্যের পরিচয়। তখন সেখানে মন টানত ইন্দ্রজাল কমিকসের বাঁধানো খণ্ডগুলো, অল্প পয়সা দিলে সেগুলো বাড়ি নিয়ে গিয়ে পড়ে ফেরত দেওয়া যেত। আশির গোড়ায় কলেজে পড়ার সময়েও ওয়েলিংটনের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোকে সজীব দেখেছি, ইংরেজি পেপারব্যাক বই যেমন কম দামে কিনেছি সেখানে, তেমনই পেয়েছি দুর্লভ ল্যাটিন ব্যাকরণ-অভিধানও। এক বার ফাদার রবের আঁতোয়ানের প্রিয় ছাত্র নলিনীরঞ্জন দাশের কাছে ল্যাটিন শেখার দুর্বুদ্ধি হয়েছিল। কিছু শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করেই অবশ্য তাতে ইতি টানি। আশির দশকের মাঝামাঝি চাকরি পাওয়ার পর প্রথম ‘সুবর্ণরেখা’য় পদার্পণ। ইন্দ্রদা-কেও সেই প্রথম মুখোমুখি দেখা। দরজার পাশেই একটা তাকে দেখি জিসিএম বার্ডউডের দি ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস অব ইন্ডিয়া বইটি সাজানো। ‘কত দাম?’ উত্তরে যে অঙ্কটি শুনলাম, তা দাম হিসেবে কমই, কিন্তু পকেটে তার অর্ধেকও ছিল না। মুখ কালো করে আবার বইটা স্বস্থানে রেখে দিচ্ছি, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন, ‘‘কী হল?’’ অত টাকা নেই। ‘‘কত আছে?’’ বললাম। ‘‘ঠিক আছে, বাকিটা পরে দিয়ে যেয়ো।’’ আপনি তো আমায় চেনেন না...। ‘‘আমি লোক চিনি।’’ সেই যে ‘লোক’ চেনা হল, শেষ দিন পর্যন্ত (২০১৩) তাতে ছেদ পড়েনি। কিন্তু ‘সুবর্ণরেখা’য় যাওয়া মানে ছিল পরশপাথর খোঁজা। ধুলোভরা এলোমেলো অজস্র বইয়ের গাদায় হঠাৎ করে কোনও বিস্ময়কর প্রাপ্তি। তার জন্য হাতে অনেক সময় থাকা দরকার। আর বই পেলেই যে তিনি বিক্রি করতে রাজি হবেন, এমনও নয়। ‘‘এই বইটা তুমি কী করবে? যা পাবে তাই জমাতে শুরু করেছ নাকি? এই বই গৌতম ভদ্রের কাজে লাগবে।’’ এমন বকুনি হামেশাই খেতাম।

গ্যালিফ স্ট্রিটের খালপাড়ে নিজেদের লাল রঙের পুরনো বাড়ির এক তলায় সুশীল গুপ্তের ভাইপো রঞ্জন গুপ্তের দোকানের মেজাজটাই আলাদা ছিল। তিনটে ঘরে সিলিং-ছোঁয়া র‌্যাকভর্তি বই, তারই একটায় অফিস। অন্য দুটোয় এমনিতে ঢোকা যেত না, ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর সেখানে ঢোকার অনুমতি পেয়েছি। কয়েক মাস অন্তর ভাল সংখ্যক বই জমা হলে রীতিমতো টাইপ করা ক্যাটালগ সাইক্লোস্টাইল করে পাঠানো হত দেশবিদেশে। বাড়িতে ডাকে ক্যাটালগ এলেই একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে পছন্দের বইগুলো দাগিয়ে নিয়ে ফোন করতাম— অবশ্যই ল্যান্ড লাইনে— এগুলো একটু রাখবেন, আমি গিয়ে দেখে নিচ্ছি। বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় সুবিধে ছিল, বেশির ভাগ সময় আর কোনও মক্কেলের অর্ডার আসার আগেই আমি পৌঁছে যেতাম। কিনতে পারতাম আর ক’টা, দাম থাকত একটু চড়ার দিকেই— দরদামেও আমি কোনও কালেই বিশেষ দড় নই— কিন্তু জীবনে দ্বিতীয় বার হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পাব না, এমন অঢেল বই যথেচ্ছ নেড়েচেড়ে দেখতে তো পারতাম। হাতে গোনা কয়েক জন বইরসিক বাদে অন্য লোককে ওখানে কখনও দেখিনি। ভারতের নানা জায়গায় তো বটেই, বিদেশেও বই যেত ওঁদের। আশির দশকের শেষ থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী নিয়মিত গিয়েছি ওখানে, চোখের সামনে দেখেছি কী করে একে একে নিভিল দেউটি। রঞ্জনদা আর তাঁর জামাইবাবু মূলত ব্যবসা দেখতেন, দু’জনেই মারা যাওয়ার পর ছোট ভাই অঞ্জন আর বেশি দিন সামাল দিতে পারেননি। ওঁদের দোকানেই দেখেছি ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ খ্যাত নিখিলনাথ রায়ের ছেলে ত্রিদিবনাথ রায়ের তিল তিল করে গড়ে তোলা যৌনবিদ্যা বিষয়ক বাংলা-ইংরেজি-ফরাসি বইয়ের আশ্চর্য সংগ্রহ টুকরো টুকরো হয়ে বিক্রি হতে, কিংবা পোস্তা রাজবাড়ির উনিশ শতকের বাংলা বইয়ের সযত্ন-রক্ষিত চমৎকার সংগ্রহ আজকের নিরিখে নিতান্ত সস্তায় চলে যেতে। অনেক বই খুব খারাপ অবস্থায় আসত। এ ধরনের বই ওঁরা নিজেরাই যত্ন করে বাঁধিয়ে দিতেন। কত দুর্লভ বই যে ওঁদের মাধ্যমে হাতবদল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিচিত্র সব ‘এফিমেরা’র সঙ্গেও ওখানেই প্রথম পরিচয়। পি টি নায়ার নিয়মিত আসতেন, ওখান থেকেই তাঁর কেনা থ্যাকার্স ক্যালকাটা ডিরেক্টরির অনেকগুলি ধারাবাহিক খণ্ড-সহ কলকাতা বিষয়ক বহু বই পরে ঠাঁই পেয়েছে টাউন হল লাইব্রেরিতে।

সুশীল গুপ্ত স্বনামে বই প্রকাশ করলেও রঞ্জন গুপ্ত প্রকাশক হননি। সুবর্ণরেখা বা আর এন প্রকাশনায় নেমেও সফল। কিন্তু এঁদের সকলেরই যেটা বিস্ময়কর গুণ ছিল, প্রাক-গুগল যুগে শুধু অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি থেকে কোন বইয়ের কোন সংস্করণের কী বৈশিষ্ট্য, কোনটা কেন দুর্লভ তকমা পেতে পারে তা গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন। বিশেষ বিশেষ বইয়ে ক’টা আর্টপ্লেট থাকার কথা সেটা পর্যন্ত ওঁদের মুখস্থ থাকত। আর জানতেন কোন পাঠকের কী বইয়ে আগ্রহ। ফুটপাতে আজও পুরনো বই মেলে, পরিতোষ ভট্টাচার্যের মতো ঝোলাওয়ালা বইবিক্রেতারা আজও টিকে আছেন। কিন্তু দোকানে বসে দুষ্প্রাপ্য বই ঘাঁটা, ভাল বই চিনতে শেখা, সঙ্গে পুরনো বই আর তার সংগ্রাহকদের মুচমুচে গল্প শোনার দিন বোধ হয় শেষ হয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন