সম্পাদকীয় ১

কবচকুণ্ডল

রাজনীতির ময়দানে তাঁহার প্রধান অস্ত্রটি ছিল সাধারণ মানুষের নিকট— শুধুমাত্র অবিচল ‘ভক্ত’ নহে, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের নিকটও— বিশ্বাসযোগ্যতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে নরেন্দ্র মোদী কি কখনও অবাক হইয়া ভাবিয়াছেন, হঠাৎ কী হইল? কোনও বাস্তব প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র যাঁহার মুখের কথায় গোটা দেশ বিশ্বাস করিয়াছিল যে ‘অচ্ছে দিন’ দরজায় কড়া নাড়িতেছে, যিনি বলিয়াছিলেন বলিয়া মানুষের প্রত্যয় হইয়াছিল যে ভারত হইতে দুর্নীতি সম্পূর্ণ মুছিয়া যাইবে, প্রতি বৎসর এক কোটিরও বেশি নূতন কর্মসংস্থান হইবে, প্রত্যেক ভারতীয়র ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা জমা পড়িবে— তাঁহাকে আজ কেন মানুষের মন জিতিবার জন্য এমন অকল্পনীয় পরিশ্রম করিতে হইতেছে? কেন নির্বাচনী প্রচারের তাড়নায় দুই দিন অন্তর অন্তর আপন রাজ্যে দৌড়াইতে হইতেছে? কেন রাহুল গাঁধীর আক্রমণ সামলাইতেও তাঁহার এমন নাজেহাল দশা? একটিই উত্তর সম্ভব: তিনি নিজের কবচকুণ্ডলটি পথপার্শ্বে হেলায় ফেলিয়া আসিয়াছেন। রাজনীতির ময়দানে তাঁহার প্রধান অস্ত্রটি ছিল সাধারণ মানুষের নিকট— শুধুমাত্র অবিচল ‘ভক্ত’ নহে, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের নিকটও— বিশ্বাসযোগ্যতা। সে বিশ্বাসযোগ্যতা তাঁহার সুদক্ষ বিপণন সংস্থাগুলি তৈরি করিয়া দিয়াছিল, না কি তাঁহার মানুষের মন বুঝিয়া বক্তৃতা করিবার স্বভাবগত প্রতিভা, সেই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু, তিনি ডলারের দামকে ফের চল্লিশ টাকায় ফিরাইয়া আনিবার ‘প্রতিশ্রুতি’ দিলেও যে মানুষ তাহা বিশ্বাস করিয়াছে, ভারতীয় গণতন্ত্র তাহার সাক্ষী। নরেন্দ্র মোদী গত এক বৎসরে সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটিই হারাইয়া ফেলিয়াছেন। তিনিও জানেন, কোন পথের ধারে কবচকুণ্ডলটি পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু ফিরিয়া কুড়াইয়া আনিবেন, সেই উপায় নাই। ডিমনিটাইজেশন বা নোটবাতিল যে এক বৎসর পূর্বে ঘটিয়া গিয়াছে। সময়ের সরণিতে বিপরীতযাত্রা অসম্ভব।

Advertisement

এক বৎসর পূর্বে, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় গোটা দেশ যখন জানিল যে রাত বারোটা বাজিলেই ৫০০ আর ১,০০০ টাকার নোট বাতিল হইয়া যাইবে, প্রাথমিক বিস্ময়ের রেশ কাটিবার পর জনমানসের দখল লইয়াছিল এক আশ্চর্য আস্থা। নগদের অভাবে নাভিশ্বাস উঠিতেছে, কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করিয়াছিলেন, যাহা হইতেছে, দেশের মঙ্গলের জন্যই হইতেছে। নোটবাতিল যাঁহাদের রুজিরুটি কাড়িয়া লইয়াছিল, তাঁহারাও সেই বিশ্বাসের বাহিরে ছিলেন না। এই আস্থা অর্থশাস্ত্রের যুক্তিনির্ভর নহে, ইহা নেহাতই মোদীজির প্রতি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ফল। তাহার পর মানুষ বুঝিলেন, নোটবাতিলে হয়রানিই সার। কালো টাকা পূর্ববৎ, সন্ত্রাসবাদী হামলাও চলিতেছে, রামা কৈবর্তের পক্ষে হাইপারমলে ঢুকিয়া ডেবিট কার্ডে সুখ কিনিয়া আনাও সম্ভব হয় নাই, বাজার ঝিমাইয়া পড়ায় নূতন কর্মসংস্থান দূরে থাকুক, পুরাতন চাকুরিও টিকাইয়া রাখা দুষ্কর হইয়াছে। মানুষ আরও দেখিল, অদম্য প্রধানমন্ত্রী নিত্যনূতন যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া চলিয়াছেন। মানুষ টের পাইল, বস্তু মিলাইতে পারে, বিশ্বাসে তেমন জোর নাই। মোদীর কবচকুণ্ডলটি খুলিয়া পড়িল।

এই পরিণতিই কি অবধারিত ছিল না? যে সিদ্ধান্তের পিছনে অর্থনীতির যুক্তি নাই, রাজনৈতিক আলোচনা নাই, বিন্দুমাত্র স্বচ্ছতা নাই, তাহাকে গোটা দেশের উপর চাপাইয়া দিলে যে বিপর্যয়ই অনিবার্য, তাহা বুঝিতে কাণ্ডজ্ঞান যথেষ্ট। সাধারণ মানুষ জিডিপি-র হিসাব বুঝেন না, কোন ত্রৈমাসিকে কোন সূচক কত শতাংশ-বিন্দু আগাইল-পিছাইল, সেই অঙ্কে নেতার বিচার করেন না। মানুষ দেখিতে চাহেন, প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি কয় আনা মিলিল। তাঁহারা কষ্ট সহিতে রাজি, ঠকিতে নহে। মোদী যদি নিজের ভুল স্বীকার করিয়া বলিতেন, যে উদ্দেশ্যেই নোটবাতিল করিয়া থাকুন, তাহা সফল হয় নাই— তবুও হয়তো বিশ্বাস বাঁচিত। কিন্তু তাঁহার অহং সেই কথার পথ আটকাইয়া দাঁড়াইল। এবং, নূতন নোট আসিয়া পুরাতন বিশ্বাসকে লইয়া গেল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন