আন্তর্জালের অন্তরালে
Online Education

ডিজিটাল-ক্লাসের বিচ্যুতি ও বৈষম্যে বাড়ছে বিকল্পের প্রয়োজন

যে দিনমজুর বাবার সেই মুহূর্তে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার সামর্থ্যই ছিল না, তিনি সরাসরিই বলেছেন, অনলাইন পড়াশোনা সব ছাত্রছাত্রীর কাছে সমান ভাবে পৌঁছতে পারছে না। তাই তা বন্ধ হোক

Advertisement

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share:

প্রতীকী ছবি।

অপ্রত্যাশিত ও দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের জেরে বাবা-মা আটকে পড়েছিলেন দেশের বাড়িতে; দূরে শহরে ভাড়াবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত ভাই-বোন। একটি মাত্র স্মার্টফোনে দাদা ক্লাস করলেও বোনটি সুযোগ পেত না। অভিমানে আত্মঘাতী হয় মেয়েটি। শোকতপ্ত বাবা আফশোস করেছেন, এ ভাবে আটকে না পড়লে নিশ্চয়ই মেয়েকেও স্মার্টফোন কিনে দিতেন। কিন্তু যে দিনমজুর বাবার সেই মুহূর্তে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার সামর্থ্যই ছিল না, তিনি সরাসরিই বলেছেন, অনলাইন পড়াশোনা সব ছাত্রছাত্রীর কাছে সমান ভাবে পৌঁছতে পারছে না। তাই তা বন্ধ হোক। লকডাউনের পঞ্চম মাসেও স্কুল কলেজ খোলার সম্ভাবনা অনিশ্চিত। পড়াশোনার ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যমের ভূমিকা তাই ক্রমাগতই অপরিহার্য হয়ে উঠছে, পাশাপাশি এই রকম ঘটনাও কিন্তু থেমে নেই। তাই ডিজিটাল মাধ্যমকে আমরা কতখানি জায়গা ছেড়ে দেব, তা ঠিক করতে গেলে এই ঘটনাগুলোর কথাও মাথায় রাখা দরকার।

Advertisement

শুধু পড়াশোনার উপচারই নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য উপকরণও যে আমাদের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে সমান ভাবে পৌঁছয় এমন কথা কেউই বলবেন না। আর স্কুল খোলা থাকলেই সব ছাত্রছাত্রী রোজ আসে বা খুব মন দিয়ে সব পড়া শোনে— এমনও নয়। তা হলে শুধু অনলাইন ক্লাস করতে না পারার জন্য এমন মর্মান্তিক পরিণতি কেন হল! ভেবে দেখলে মনে হয়, স্মার্টফোন হাতে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারাটা পড়াশোনার একটা আলাদা মাত্রা, যা কিছুটা সামাজিক সম্মানের সমার্থক। অর্থাৎ স্মার্টফোনের অভাবে ক্লাসে উপস্থিত না থাকতে পারা মানে যেন সকলের চেয়ে আলাদা হয়ে পিছিয়ে পড়া! সংবেদনশীল কিশোর বয়সে এ সব অকিঞ্চিৎকর বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ থাকে যে!

বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে যেটুকু পড়াশোনা করাবার চেষ্টা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আর পড়াশোনা করতে চাইলে এই মাধ্যমটি খুবই সুবিধাজনক। কারণ, বাড়িতে বসেই পড়াশোনা আর ক্ষেত্র বিশেষে রেকর্ডিং দেখে বার বার বুঝে নেওয়ার সুযোগও থাকে। কিন্তু তাই বলে সব ক্ষেত্রে অনলাইন পড়াশোনাকেই উন্নততর ব্যবস্থা বলে ভেবে ফেললে মুশকিল। কারণ, পড়াশোনা কখনওই সমসত্ত্ব বিষয় নয়। বরং, তা স্বভাবতই বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরীয়। তাই যে কোনও বিষয়ের মতোই অনলাইন পড়াশোনার ক্ষেত্রেও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষে যে ভাবে সুবিধা নেওয়া সম্ভব, স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই অন্য রকম হতে পারে। সেই অন্য রকম দিকগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক।

Advertisement

অনলাইন পড়াশোনার জন্য দরকার মাথাপিছু একটি উন্নত মানের স্মার্টফোন বা কম্পিউটার, একটি আলাদা ঘর আর নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট যোগাযোগ। প্রথমটির অর্থ হল, যে কোনও বয়সের ছেলেমেয়ের হাতে সারাদিনের জন্য প্রায় নিঃশর্তে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া! কারণ পড়াশোনা মানে তো শুধু ক্লাসের সময়টুকুই নয়, যাবতীয় নোটস এবং বাড়ির কাজ ফোন থেকেই টুকে নেওয়া, বুঝে নেওয়া এবং কাজ হয়ে গেলে আবার ছবি তুলে ফোনের মাধ্যমেই ‘পোস্ট’ করা। অর্থাৎ, ডাউনলোড-প্রিন্ট (তার জন্য বাড়িতে প্রিন্টার থাকা আবশ্যক) বা কপি-আপলোডের চক্করে সারা দিন হাতে ফোন। কিছু কিছু স্কুল আবার আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছুই (বইখাতায় লোগো আর স্টিকার লাগানো ইত্যাদি) অনলাইন করাবার চেষ্টা করছে। সে আরও বড় চাপ। সুতরাং যে বাড়িতে দু’টি ছেলেমেয়ে অনলাইন ক্লাস করছে, সেখানে শুধু তাদের জন্যই আলাদা আলাদা ফোনের ব্যবস্থা না করলেই নয়। আর দ্বিতীয় বিষয়টা আপনার হাতেই নেই, ফোন বা ডেটা কিনতে পারেন কিন্তু পরিষেবা (সংযোগ এবং গতি) তো আলাদা করে কিনতে পারবেন না! তাই স্মার্টফোন হাতে বাচ্চা বসে গেলেই সে ভাল করে শুনতে বা দেখতে পাচ্ছে কি না (না পেলে সে কী করছে)— তা বোঝা মুশকিল। অর্থাৎ এত দিন যে ডিজিটাল মাধ্যম থেকে ছেলেমেয়েদের দূরে রাখার জন্য লড়েছেন, খুব অল্প দিনের মধ্যে তার উল্টো পথে হেঁটে স্মার্টফোন নামক প্রলোভনটিকে নিজের হাতেই বাচ্চার মুঠোয় তুলে দিতে হচ্ছে। এর মানে হল পড়াশোনা বজায় রাখতে গিয়ে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে ‘স্ক্রিন টাইম’। ফলে, অনেক বাচ্চাই স্ক্রিনের বাইরে তাকাতেই চাইছে না। আর আমাদের চেনা বৃত্তের বাইরে যাদের ফোন চার্জ করাতে গেলে দুটো নদী পার হতে হয় বা যাদের সেই আর্থিক সামর্থ্যটুকুও নেই (আবাপ ২৭, ২৮ জুলাই) তাদের কথাই বা ভুলে থাকা যায় কী করে? শিক্ষা তো তাদেরও মৌলিক অধিকার!

এ সব উপকরণ থাকলে ছাত্র অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পেল, এটুকুই আপনার হিসেবের মধ্যে থাকল। তার বাইরেও কিছু যোগ-বিয়োগ রয়েছে। দেখা গিয়েছে, অনলাইনে উপস্থিতির হার এমনিতে যা হয় তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ স্কুলে যাক না যাক, ফোন হাতে বসে পড়তে ছাত্রদের দিব্য আগ্রহ। কিন্তু স্কুলের (এমনকি কলেজেরও!) যে বিচ্ছু ছাত্রেরা পিছনের বেঞ্চে বসে দুষ্টুমি করে, অনলাইন ক্লাসে তারা শান্তশিষ্ট বসে শুধু মন দিয়ে পড়া শুনবে, এটা সব সময় না-ও হতে পারে। ক্লাস চলাকালীন নিজেদের মধ্যে চ্যাট, অন্য পাতায় গিয়ে অন্য কাজ এ সবই চলতে পারে এবং চলছেও। তফাত হল মুখোমুখি ক্লাসে ছাত্রের অমনোযোগ যেটুকু নজরে আসে, অনলাইন ক্লাসে সেটাও হয় না। এই ব্যবস্থার চাপে বাচ্চারা যে বেশ ক্লান্তও হয়ে পড়ছে, সে কথাও সত্যি। তাই অন্তত ছোটদের ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষকের শেখানো আর ছাত্রের শেখার মাঝখানে অগোচরেই অনেকটা ফাঁক থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। ভার্চুয়াল ক্লাসে পড়িয়ে দিয়ে বা যত্নসহকারে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ‘করিয়ে’ দিয়ে শিক্ষক ভাবলেন ছাত্রেরা শিখে গেল। কিন্তু হাতেকলমে কাজ না করায় ছাত্ররা হয়তো আসলে শিখলই না। অর্থাৎ, অনলাইন ক্লাস তার যাবতীয় স্মার্টনেস দিয়ে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করতে পারে— যার আড়ালে ছাত্রদের না-বোঝা, না-শেখা চাপা পড়ে থাকে।

নিয়মিত অনলাইনে পড়াতে গেলে, ঠিক অনুরূপ ব্যবস্থা কিন্তু শিক্ষকের দিক থেকেও বহাল থাকা দরকার। লকডাউনের শুরু থেকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একেবারে স্কুল বা কলেজের মতো সময় ধরে ক্লাস নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে শিক্ষকদের। প্রতি মুহূর্তে সমস্ত কাজকর্মের রেকর্ড রাখা, প্রায় প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব দেওয়া— শিক্ষকদের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হচ্ছে। না পারলে অপমান, মাইনে কাটা এবং ছাঁটাইয়ের ভয় দেখানো চলছে। অর্থাৎ রীতিমতো অত্যাচারী হয়ে উঠেছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে যাঁরা পড়ান, তাঁরা অনেকেই যেখানে থাকেন সেখানে ইন্টারনেটের অবস্থা সুবিধের নয়। নেটের যোগাযোগ পেতে বিচিত্র জায়গা থেকে ক্লাস নিতে হচ্ছে। এ তো সাধারণ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নয়, পরিবারের সহায়ক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে আছে। এই অবস্থায় পরিবারের সব কর্তব্য বাদ দিয়ে সারা দিন ক্লাস নিয়ে চলা অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার পক্ষেই খুবই সমস্যার হয়ে উঠছে।

সুতরাং অনলাইন পড়াশোনা বলতে যে ঝকঝকে এবং নিখুঁত ছবিটি ভাসে, আসলে তার মলাটের নীচেও অনেক অন্ধকার। সুতরাং শিক্ষা মন্ত্রক যতই অনলাইন পড়াশোনার দিকে ঝুঁকে পড়ুক, মনে রাখতেই হবে— সব জায়গা কলকাতা নয় আর স্মার্টফোন-নির্ভর এই ব্যবস্থা সব ছাত্রের কাছে পৌঁছতে পারে না। সামাজিক মাধ্যমে দু’-একটা মেসেজ করা আর টানা অনলাইন ক্লাস করতে পারা এক নয়। বরং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এই ব্যবস্থাটিকে অপরিহার্য না ভেবে অন্তত স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু বিকল্প মাধ্যম খুঁজে বার করতেই হবে। যেমন কাজে লাগানো যেতে পারে টেলিভিশন, স্থানীয় ক্লাব এবং কেব্‌ল পরিষেবাকে। মাস্টারমশাইরা অনেকেই এখন ক্লাসে পড়াবার ভিডিয়ো বা অডিয়ো তৈরি করে ছাত্রদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠাচ্ছেন। এই ভাবে ‘পড়ানো’ যদি স্থানীয় কেব্‌ল চ্যানেলের মাধ্যমে সম্প্রচার করা যায়, তা হলে টেলিভিশনের মাধ্যমেই কিছুটা পড়াশোনা চলতে পারে। অনেকটা যে ভাবে সরকারি উদ্যোগে দূরদর্শনে ক্লাস হচ্ছিল, সেই রকম। পাড়ার ক্লাবে একটি কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে গুগল মিট বা জ়ুম অ্যাপে যে ভাবে পড়ানো হয়, সে ভাবেই ক্লাস অনুযায়ী পড়ানো যাবে। নিজস্ব স্মার্টফোন না থাকলেও দূরত্ববিধি মেনে ছাত্ররা ক্লাবে বসে এই সুবিধা নিতে পারবে। আশঙ্কার কিছু নেই, কারণ যে কোনও পাড়ায় একই ক্লাসের এই রকম ছাত্র হয়তো মাত্র কয়েক জনই মিলবে। এই ভাবে ক্লাস পরিচালনার জন্য অবশ্যই বেশ কিছুটা প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা দরকার। সেটা আপাতত ঘরবন্দি শিক্ষকেরাই করে নিতে পারবেন। এই পাঠদান হয়তো অনলাইন ক্লাসের মতো হবে না। কিন্তু যেটুকু হবে তা মোটামুটি সকলের কাছেই পৌঁছতে পারবে এবং যারা সেইটুকুর ভরসায় থাকে তাদের উপকার হবে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ তো এ ভাবেই হয়। তা না হলে, আমাদের পড়াশোনার মধ্যে শুধু বৈষম্যই নয়, বড় বড় ফাঁক থেকে যাবে।

সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন