মত বদলানো যায় বইকি

রাজনীতিতে ভোটদাতার আস্থা কমছে, তাই বাড়ছে সঙ্কীর্ণতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হালফিলের একটি অভিজ্ঞতাও এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:১২
Share:

প্রতীকী চিত্র।

অন্য জাতি, অন্য ধর্ম, অন্য জনগোষ্ঠী, এমনকি অন্য লিঙ্গের লোকেদের প্রতি রাখঢাক না করেই বিদ্বেষ প্রকাশ করার অভ্যাসটা সারা বিশ্বে নেতাদের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে। জনপ্রিয়তা আদায়ের এটাই যেন উপায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাঙ্গেরি, ইটালি থেকে ভারত— জাতিবিদ্বেষ এবং/অথবা অন্ধ ও বিকারগ্রস্ত গোঁড়ামি ছাড়া যাঁদের নীতি ও কর্মসূচিতে আর কিছুই নেই, সেই গোত্রের নায়করাই এখন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করছেন। তাঁরাই ঠিক করে দিচ্ছেন নির্বাচনের প্রধান বিষয় কী হবে, বা দেশ কোন পথে চালিত হবে। নিজের পরিচয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে একটা লোক তার শ্বেতাঙ্গ সত্তাকে কতটা আঁকড়ে ধরছে, সেটাই ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিল। অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ বা অন্য কোনও প্রশ্ন ততটা গুরুত্ব পায়নি।

Advertisement

...মনে হয় যেন অপরের প্রতি এমন বিদ্বেষ আজ সুনামির মতো প্রবল হয়ে উঠেছে। এমনই তার দাপট, যে পক্ষপাত দূর করার জন্য নানা প্রস্তাব করলেও সেগুলো নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হতে থাকে। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করা দরকার। কাজে বা চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষ কী বেছে নিচ্ছেন, সেটা অনেক সময়েই সামাজিক সমস্যার কারণ নয়, তার লক্ষণ। অন্যের অকারণ বিরুদ্ধতা অনেক সময়েই নিজেকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা। জগতে যা কিছু ভুলভাল হচ্ছে বলে আমাদের মনে হয়— যেমন যখন মনে হয় যে যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছি না, আমাকে কেউ মূল্য দিচ্ছে না, আর্থিক সঙ্কটে ভুগছি— তখন অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনের ভিতরে মাথা চাড়া দেয়।

এ থেকে চারটি কথা বোঝা যায়। প্রথমটা খুবই স্পষ্ট— যাঁরা জাতিবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করেন, জাতিবিদ্বেষীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন অথবা তাঁদের ভোট দেন (‘ধিক তাঁদের’), তাঁদের অনেকেরই মনে এই ধারণা কাজ করে যে দুনিয়ায় তাঁদের কোনও সম্মান নেই। তাই তাঁদের প্রতি যদি অবজ্ঞার ভাব দেখানো হয়, তবে তাঁদের অসম্মানিত হওয়ার বোধ আরও পোক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, কোনও বিষয়ে কারও অযৌক্তিক পক্ষপাত থাকার মানে এই নয় যে আর সব কিছুই তাঁর কাছে অবান্তর; অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষের জন্য যাঁরা পরিচিত, তাঁরাও অন্য নানা ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান (বিভিন্ন উপলক্ষে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে)। ১৯৯০-এর দশকে এবং এই শতকের গোড়ার দিকে উত্তর ভারতে প্রধানত জাতপাতের ভিত্তিতে প্রবল মেরুকরণ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মোটামুটি ২০০৫-এর মধ্যে তার দাপট কমে আসে। জাতপাতের কাঠামোয় নীচের দিকে থাকা যে সব গোষ্ঠী সরাসরি জাতপাত-ভিত্তিক দলগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল, সেই নিম্নবর্ণের মানুষেরা ভাবতে শুরু করলেন, নিজের নিজের দলের কাছ থেকে তাঁরা কতটুকু কী পেয়েছেন। এমন একটি দলের নেত্রী মায়াবতী নিজেকে সমস্ত দরিদ্র মানুষের— উচ্চবর্ণের দরিদ্রেরও— নেত্রী হিসেবে তুলে ধরা শুরু করলেন। এবং তার ভিত্তিতেই ২০০৭ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন। অর্থাৎ সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনীতি ছেড়ে সবাইকে নিয়ে চলার রাজনীতির পথে হেঁটে সুফল পেলেন তিনি।

Advertisement

আরও পড়ুন: আপত্তি কেন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হালফিলের একটি অভিজ্ঞতাও এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ। বহুনিন্দিত সুলভ চিকিৎসা আইনের (‘অ্যাফর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’) অদ্ভুত ইতিহাসের কথা বলছি, সাধারণ ভাবে যার পরিচিত নাম ওবামাকেয়ার। স্বাস্থ্য বিমার এই বিশেষ উদ্যোগটি এনেছিলেন ‘কৃষ্ণাঙ্গ কেনীয় মুসলমান’ বারাক ওবামা, আমেরিকায় যিনি অনেকেরই ঘৃণার পাত্র। অনেক রাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নররা এই বিমা চালু করার কথা বিবেচনা করতেও রাজি ছিলেন না। ওই আইন বলবৎ করার একটা প্রধান উপায় ছিল ‘মেডিকেড’ নামক বিমা ব্যবস্থা, কোনও রাজ্য তা চালু করলে ফেডারাল বা কেন্দ্রীয় সরকার সেই রাজ্যকে ভর্তুকি দিত। ওবামা-বিরোধী রিপাবলিকান গভর্নরদের অনেকেই সেই ভর্তুকিও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অথচ ২০১৮ সালে আইনসভা অর্থাৎ কংগ্রেস-এর ভোটের সময় দেখা গেল, উটা, নেব্রাস্কা, আইডাহো-র মতো রিপাবলিকান-প্রধান রাজ্যেও মেডিকেড একটা বড় নির্বাচনী প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই তিন রাজ্যেই মেডিকেড ভোটদাতাদের কাছে বড় সমর্থন পেল। পাশাপাশি, কানসাস আর উইসকনসিন-এ আগের রিপাবলিকান গভর্নররা মেডিকেডের বিরোধিতা করেছিলেন, সেখানে গভর্নর পদের ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে এই প্রকল্পের পরিধি প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং জয়ী হলেন। এই পরিবর্তনের মানে এমন নয় যে ওই রাজ্যগুলিতে রিপাবলিকান ভোটদাতারা রাতারাতি ডেমোক্র্যাট হয়ে গেলেন। বস্তুত, হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস ও সেনেট— আইনসভার দুই কক্ষেই এই দুই রাজ্যের ভোটে রিপাবলিকানরা ভাল ফল করলেন, তাঁদের মতামত অত্যন্ত রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু এই চিকিৎসা বিমার প্রশ্নে ভোটদাতারা অনেকেই দৃশ্যত রিপাবলিকান নেতাদের হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করেন। তাঁরা যেন ঠিক করেছিলেন, নিজেদের জন্য যেটা ভাল বলে মনে করছেন, সেটার পক্ষেই ভোট দেবেন। অর্থনীতির যুক্তি ট্রাম্পকে হারিয়ে দিল।

তৃতীয় বিষয়টি এরই সঙ্গে সম্পর্কিত। ভোটদাতারা যখন জাতি, জনগোষ্ঠী বা ধর্মের ওপর জোর দেন, এমনকি যখন জাতিবিদ্বেষী মতামতকেও সমর্থন করেন, তখনও এটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে এগুলি তাঁদের অন্তরের আবেগভরা বিশ্বাস। তাঁরা এটা অবশ্যই বোঝেন যে, রাজনৈতিক নেতারা সুবিধে মতো জাতি, জনগোষ্ঠী বা ধর্মের তাস খেলেন। সব জেনেও তাঁরা যে এই বিদ্বেষ-প্রবণ নেতাদের ভোট দেন তার একটা কারণ হল, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটার উপর তাঁরা ভরসা হারিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের বুঝিয়ে ফেলেছেন যে, সব নেতাই মোটের উপর এক রকম। আর তা-ই যদি হয়, তবে বরং এমন কাউকে ভোট দেওয়া ভাল যাঁর সঙ্গে তাঁরা নিজেদের কিছুটা মেলাতে পারেন। অনেক ভোটদাতা যে বর্ণ-জাতি-ভাষার ভিত্তিতে, বা অপরের প্রতি বিদ্বেষের ভিত্তিতে ভোট দেন তা কেবলমাত্র তাঁদের উদাসীনতার পরিচয়— কিছুতেই কিছু যায় আসে না, এই মনোভাবের প্রকাশ। কিন্তু তার মানে এ-ও দাঁড়ায় যে, তাঁদের মত বদলে দেওয়ার কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। নির্বাচনের ফলের উপর কী নির্ভর করছে, সেটা তাঁদের বোঝাতে পারলে তাঁদের মত বদলে দেওয়া আশ্চর্য রকমের সহজ হতে পারে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি জাতপাতের বিচারের জন্য বিখ্যাত। ২০০৭ সালের ভোটের আগে সেই রাজ্যে পরীক্ষামূলক ভাবে একটি প্রচার চালানো হয়েছিল। গান, পুতুলনাচ, কিছু পথনাটিকা, এই সব প্রকরণ ব্যবহার করে মানুষকে একটা কথাই বলা হয়েছিল: উন্নয়ন দেখে ভোট দিন, জাত দেখে নয়। এই প্রচারের ফলে দশ শতাংশ ভোটদাতা তাঁদের নিজেদের জাতের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে অন্য প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন।

এখান থেকেই আমাদের চার নম্বর এবং শেষ বিষয়টিতে পৌঁছতে পারি, যেটি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরের প্রতি যুক্তিহীন বিদ্বেষ দূর করার সবচেয়ে ভাল উপায় কী? স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয়, যাঁরা ভুল এবং বিকৃত ধারণার বশবর্তী, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি বিতর্কে নামতে হবে, তাঁদের বোঝাতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা এই লড়াইয়ের সদুপায় না-ও হতে পারে। তার বদলে হয়তো ওই নাগরিকদের এটা বোঝালে কাজ হবে যে, অন্যান্য জরুরি নীতি ও প্রকল্প কেমন কী কাজ করছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানো বেশি দরকার। তাঁদের খেয়াল করিয়ে দেওয়া যায় যে নেতারা বিস্তর প্রতিশ্রুতি দেন এবং নানা আড়ম্বর করে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের ভানও করেন। কিন্তু ওই আড়ম্বর করার চাইতে বেশি কিছু করেন না, কারণ ঢাকঢোল পেটানো সহজ কিন্তু প্রতিশ্রুতি কাজে রূপায়িত করা সহজ নয়। অন্য ভাবে বললে, জনজীবনকে উন্নত করার বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে জনপরিসরে বিতর্ক-আলোচনাকে ফের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। সবার সামনে কথা বলা মানে যে অতি সামান্য কাজ ঢাকতে অতি বড় বড় কথা বলা নয়, তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর সেই সঙ্গে আর একটা কাজ অবশ্যই করতে হবে। বহু মানুষের মনে যে ক্রোধ ও বঞ্চনাবোধ জমেছে তা দূর করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ জেনেও সেই উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী (২০১৯) অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলোর ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস’ (জাগরনট) থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন