তিরিশ বছর সাংবাদিকতা করার পর আজ বুঝতে পারছি সৎ ভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করার মতো কঠিন কাজ এই মিডিয়া-যুগে কতটা কঠিন। যখন মুদ্রণ ব্যবস্থা চালু হয়, তখন তা ছিল প্রথম মিডিয়া যুগ। আর আজ, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দাপট দেখে মার্ক পোস্টার ১৯৯৫-এ ঘোষণা করেন এটি দ্বিতীয় মিডিয়া যুগ। জানি না, এখন ফেসবুক-টুইটার-ডিজিটাল— মানে ই-মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তিকে তৃতীয় মিডিয়া যুগ বলব কি না!
কিন্তু, সাংবাদিককে যে কোনও বিষয়ে একটা পক্ষ নিতেই হবে? Either— or? হয় তুমি মোহনবাগান, না হলে ইস্টবেঙ্গল? হয় তুমি তৃণমূল, নয়তো সিপিএম? কিছু দিন আগে টাইমস নাও–এর অনুষ্ঠানে অর্ণব গোস্বামী আমাকে বলেছিলেন, ‘হোয়াই ইউ আর নট টেকিং এনি সাইড?’ আমার জবাব ছিল, ‘এখানে মহম্মদ সেলিম সিপিএম, ডেরেক ও’ব্রায়েন তৃণমূল, সিদ্ধার্থ সিংহ বিজেপি। আমি ভারতীয় মুক্ত বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করি। কিন্তু, সাংবাদিক জগতে কোনও দলের ‘জার্সি ’ পরতে রাজি নই। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গেও মতপার্থক্য হতে পারে, তবে তা প্রকাশ্যে বলতে পারি না, যত দিন আমি এ সংস্থার কর্মী।
তার মধ্যে টেলিভিশন চ্যানেলে এত লোক মিলে একসঙ্গে এত কথা কাটাকাটি করে যে, সব সময় নিজের বক্তব্যকে স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকে না। ওয়ান লাইনার-এ সর্বদা পুরো ব্যাখ্যা সম্ভব হয় না। ঠিক যেমন হয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর, ‘জিন্না ধর্মনিরপেক্ষ’— এই মন্তব্যকে ঘিরে। আডবাণীকে বিজেপি-র সভাপতির পদটি খোয়াতে হয়েছিল। করাচিতে আডবাণীর সঙ্গে আমি সে দিন জিন্নার সমাধিতে ছিলাম। আডবাণী বলেছিলেন, জিন্না ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল তিনি বলতে চেয়েছেন ‘জিন্না ধর্মনিরপেক্ষ’। দেশভাগের পর পাকিস্তান গঠনের পরেও তিনি সে কথা তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন।
ক’দিন আগে জি টিভিতে একটা বিতর্কে অংশ নিই। বিতর্কের বিষয় ছিল, ভারতীয় মিডিয়া কি হিন্দু বিরোধী? আমার মূল বক্তব্য ছিল, সমাজে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব ও প্রতিফলন হয় মিডিয়ার উপর। সংখ্যালঘু তোষণ ও ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি কখনই ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়। সেই ‘মাইন্ড সেট’ ভারতীয় মিডিয়ার একাংশের উপর প্রভাব ফেলে। আমার মনে হয়—
১) সাচার কমিটির সুপারিশ মেনে গরিব সংখ্যালঘু মুসলমানদের আর্থিক উন্নয়ন অনেক বেশি জরুরি, তোষণের রাজনীতির চেয়ে।
২) রাষ্ট্রপতি ভবনে বা বিদেশ মন্ত্রকে ইফতার পার্টি হয়, হোলি মিলন হয় না! বিজয়া দশমী বা ছট হয় না! খ্রিস্টানদের জন্য বড়দিন পালন, এমনকী পার্সি সংখ্যালঘুদের জন্যও কোনও উৎসব হয় না। তার মানে ইফতার পার্টি একটা পলিটিক্যাল সিম্বলিজমে পরিণত হয়েছে। এতে মুসলমানদের কোন উন্নয়ন হচ্ছে? ইজরায়েল ও মার্কিন দূতাবাসেও বেশ কয়েক বছর ধরে ইফতার পার্টি হচ্ছে— তাতে কী প্রমাণ হয়?
৩) নরেন্দ্র মোদী খ়ড়্গপুরের জনসভায় আজান শুনে বক্তৃতা থামিয়ে দেন। আমি মনে করি, আজানের প্রতি এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সিম্বলিক হলেও সমর্থনযোগ্য। কট্টর হিন্দুরা এই অবস্থানে ক্ষিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু, মুসলমান ভাইদের এই অবস্থানকে সমর্থন করাই তো উচিত। প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদী-বিজেপি-সংঘ— এমনকী গোধরার দাঙ্গা থেকে মনকে মুক্ত করেই তো বিষয়টি দেখতে হবে। আসলে উগ্র মুসলিম সমাজ মোদী ও বিজেপিকে ধর্ম নিরপেক্ষ পথে এগোতে দিতে চায় না। তাতে উগ্র ইসলামিক মৌলবাদীদেরও সুবিধা। আসলে দু’পক্ষের উদ্র সমর্থকেরা একে অন্যের পুরিপূরক। মুদ্রার দু’টি পিঠ।
এই অনুষ্ঠান দেখে ফেসবুকে অনেকে ব্যক্তিগত ভাবেও আমাকে আক্রমণ করেছেন, নানা বিশেষণে। কেউ বলেছেন, মোদী ভক্ত। কেউ বলছেন, চাড্ডি! কেউ বলছেন, মুসলিম বিরোধী।
আসলে আমি নিজে মনে করি, সত্য আসলে অধিকাংশ সময়েই মধ্যপন্থায় অবস্থান করে। যদি বলি, মোদীর দল কানহাইয়ার সঙ্গে জেএনইউতে যা করেছে তা সমর্থন যোগ্য নয়। কানহাইয়াকে নেতা করে দিল বিজেপি। তার মানেই আমি Left wing? anti-Modi? আবার যদি বলি, মোদী পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টাকে সমর্থন করি, সুফি সম্মেলনেও আমি খুশি, বরং মুসলমান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত স্কালক্যাপ না পরা আমি সমর্থন করিনি, সেটা রাজনৈতিক কমপালশন— তার মানে আমি মোদীভক্ত। ইস্যুভিত্তিক, বিষয়ভিত্তিক সমর্থন বা বিরোধিতা করা যায় না? হয় সবটা সমর্থন করতে হবে, নচেৎ পুরো বিরোধিতা!
আর ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা, চরিত্র হনন কি অভিপ্রেত? মহম্মদ জিম নওয়াজ আমার ফেসবুক বন্ধু— তিনি সরব হন, ব্যথিত হন, উত্তরবঙ্গ সংবাদের এক সাংবাদিকের মুসলিম-বিরোধী বক্তব্যে। আমাকেও সেই মন্তব্যকারীর সঙ্গে একই বৃত্তে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমি কিন্তু ওর ব্যক্তিগত বিরোধিতা করিনি। বরং কেউ যদি মুসলিম বিরোধী মন্তব্য করেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করেন, তবে আমি তার তীব্র নিন্দা করব।
আসলে সাম্প্রদায়িকতাবাদকে অতীতের অবশিষ্ট হিসাবে দেখার অভ্যাস আমাদের ত্যাগ করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতাবাদ আসলে একটি আধুনিক মতাদর্শ। ধর্মীয় Revivalism-এর সমর্থক শব্দ সাম্প্রদায়িকতা নয়। ধর্মের সঙ্গে ধর্মের লড়াইও এ দেশে কম হয়নি। কিন্তু, সাম্প্রদায়িকতার বিভাজিকা রেখাকে ঔপনিবেশিক শক্তি আরও উস্কে দেয় সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে, ‘বাবর নামা’ পড়ে আমার বাবরকে বহু বিষয়ে উদার বলেই মনে হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙাকে তীব্র ভাষায় চিরকাল নিন্দা করেছি। আবার এটাও মনে হয়েছে, এই মসজিদ ভাঙায় সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে বিজেপি-রই। বাবর শত্রু হলেও রানা সঙ্গ (সংগ্রাম সিংহ) ও ইব্রাহিম লোদীর সাহস ও বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। রানা সঙ্গার বিধবা রানির জন্য জায়গীরের ব্যবস্থা করেন। ইব্রাহিমের বৃদ্ধা মাতাকে আশ্রয় দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। (সূত্র: সা’আদুল ইসলাম, তর্কে তক্কে)
আবার আকবর সম্পর্কে সেই কোন শৈশব থেকে প্রশংসা শুনে আসছি। অমর্ত্য সেনও আকবরের ‘দীন-ই-ইলাহি’ ধর্মের বৃহৎ চিত্রটির প্রশংসা করেছেন। আবার গোলাম আহমেদ মোর্তজার ‘চেপে রাখা ইতিহাস’ পড়ে এক অন্য আকরবকে জানা যায়। সেখানে আকবর এক লম্পট, ব্যাভিচারী সম্রাট। ঐতিহাসিক ডঃ স্মিথকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, দীন ইলাহি নামক ধর্মবিশ্বাস ছিল হাস্যকর আভিজাত্য এবং অসংযত স্বৈরাচারের স্বাভাবিক ফল। একই সমালোচনা আছে শিবাজিকে নিয়ে। আবার, ঔরঙ্গজেব আমাদের গড়পড়তা ভারতীয়দের কাছে খলনায়ক। কিন্তু, লাহৌরে গিয়ে দেখেছিলাম ঔরংজীব এক জনপ্রিয় নাম। ওখানে ‘মুসলিম’ কাগজের এক সম্পাদকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তাঁর নাম ছিল ঔরংজীব।
আবার জাতীয় আন্দোলনের সময় শিবাজি উৎসব নিয়ে খুব সমস্যা হয়। বরিশালে শিবাজি উৎসবে মুসলমানরা যোগ দেননি (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯০৪)। অশ্বিনী কুমার দত্ত লেখেন, ‘মুসলমান ভাইগণ। আজ তোমরা না আসিয়া প্রাণে বড় কষ্ট দিয়াছ। আমরা তোমাদিগের মহাপুরুষগণের পদে প্রমাণ করিতেছি। তোমাদিগকে শিবাজী যাহা করিয়াছিল তাহা যদি তোমরা না ভোল, তবে তোমরা যাহা আমাদিগকে করিয়া দিলে তাহা আমরা কেমন করিয়া ভুলিব?’
আবার ঐতিহাসিকরা আজ বলেন, শিবাজি উৎসব করার দরকার কী ছিল? এতে তো সাম্প্রদায়িক বিভেদ বেড়েছে। যেমন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার মনে করেন, হিন্দু উগ্রবাদ মুসলিম বিচ্ছিন্নতার জন্মদাতা। হিন্দু মহাসভা যদি নাম হয় সংগঠনের, তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হতে এই সংস্থায় যোগ দিতে কী ভাবে উৎসাহী হবে মুসলমান সমাজ?
আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি দল, গোষ্ঠী বা কোনও একটা জার্সি গায়ে দিয়ে কথা বলছি না। বেদের যুগে হিন্দুরা গরু খেত, গরু ভোজনে কোনও বাধা দেওয়া অনুচিত এটা আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি। খাদ্যাভাস নিয়েও বিভেদ? শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেবাসে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আধিপত্য আজও থেকে গিয়েছে, তা থেকে মুক্তমনে পুনর্মূল্যায়ণের পক্ষে আমি।
মীনহাজ-ই-সিরাজ-এর তবকাত-ই-নাসিরী কেন যে ছাত্রজীবনে পড়িনি তার জন্য দুঃখবোধ হয়। দিল্লি সম্রাটের প্রধান কাজি, মীনহাজ-ই-সিরাজের এই বইটি উপমহাদেশের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থনা। মূল ফারসি থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। আবার আমার মুসলমান এবং নাস্তিক বন্ধুদেরও বলি, রামকৃষ্ণের কথামৃত পড়তে। এটি নিছক ধর্মগ্রন্থ নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের এক আকর-গ্রন্থ।
আসলে মুক্তমনটাকে নিয়েই বড় জ্বালা। মুক্তমন মানেই সুবিধাবাদ নয়। মুক্তমনা আমি নিজে, নাস্তিক না আস্তিক তাই বুঝতে না পেরে, অজ্ঞেয়বাদী হয়ে জীবন কাটাই। মাকর্সবাদের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকলেও ইসলাম, বুদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম— একই ভাবে প্রতিটি ধর্মে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি। এই আত্মপরিচয় অচলায়তনের নম্বর দেওয়া কয়েদির নয়। তবু আছি মানুষের পক্ষে। মানুষের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় মুক্তি আমাদের।