উজ্জ্বল হতে গিয়েও অনুজ্জ্বল বিরোধী ঐক্যের ছবিটা

চাইলেই ঝড় তোলা যায় না। অস্ত্র হাতে পেলেই, তার ঐক্যবদ্ধ প্রয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভারতীয় রাজনীতির এই চরিত্র বেশ স্পষ্ট ভাবে ধরা দিল গত কয়েক দিনে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৫
Share:

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন মমতা। ছবি: সংগৃহীত।

চাইলেই ঝড় তোলা যায় না। অস্ত্র হাতে পেলেই, তার ঐক্যবদ্ধ প্রয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে না।

Advertisement

ভারতীয় রাজনীতির এই চরিত্র বেশ স্পষ্ট ভাবে ধরা দিল গত কয়েক দিনে।

প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধীদের মতামতে গুরুত্ব দিতে নারাজ, তখন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়া যাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিক থেকেই এই আহ্বান প্রথম শোনা গিয়েছিল। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বা জনসাধারণের হয়রানির বিরুদ্ধে সরব যে সব দল, তাদের প্রায় সকলেরই সমর্থন ছিল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবে। কিন্তু বিরোধী ঐক্যের বিপুল প্রদর্শনীর সে প্রস্তাবনা কার্যক্ষেত্রে মূষিক প্রসব করল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বড়সড় সংসদীয় দলকে সঙ্গে নিয়ে স্বমহিমাতেই বিরাজ করলেন রাজধানীর রাজপথে এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে। কিন্তু বিরোধী শিবির থেকে যত জনকে সঙ্গে পাবেন বলে আশা করেছিলেন, তত জনকে পেলেন না।

Advertisement

কংগ্রেস, বাম বা বহুধাবিভক্ত জনতা পরিবার— অনেকেরই সঙ্গেই কথা হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সিংহভাগেরই আপত্তি ছিল না রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজার কড়া নাড়ার প্রস্তাবে। আজও সে প্রস্তাবে তাঁদের নীতিগত আপত্তি নেই। কিন্তু কারও মনে হল বড় তাড়হুড়ো হচ্ছে, কারও মনে হল সংসদে সরকার পক্ষের জবাবটা আগে চাওয়া দরকার, কারও মনে হল রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়া শেষ বিকল্প হওয়াই ভাল।

ঐক্যের তাড়না যদি সত্যিই থাকে, সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীনকে ঘিরে ফেলার অদম্য তাগিদ যদি থাকে, তা হলে সম্ভাবনাময় ইস্যু হাতে পেয়েও কি সময়-অসময়ের তুচ্ছ কাটাছেঁড়ায় মেতে উঠে ঐক্য প্রদর্শনের অনবদ্য মঞ্চটা বিরোধী দলগুলি হাতছাড়া করত?

ভারতীয় রাজনীতির স্রোতটা আসলে শুধু জোয়ার-ভাঁটায় নিয়ন্ত্রিত নয়। অনুকূল-প্রতিকূলের দ্বিমাত্রিকতাতেও এ স্রোতের গতিপ্রকৃতির পরিমাপ হয় না। এখানে চোরাস্রোত অনেক রকমের। আবর্ত পদে পদে। তাই তৃণমূলের পাশে বামেরা হাঁটতে অস্বস্তি বোধ করেন, কংগ্রেস বা শিবসেনাকে আম আদমি পার্টি অস্পৃশ্য মনে করে, সপা আর বসপাকে এক মঞ্চে কিছুতেই পাওয়া যায় না, জয়ললিতা-করুণানিধি কোনও দিনই এক সুরে কথা বলতে পারেন না।

ভারতীয় রাজনীতিতে বাধ্যবাধকতার এই নিদারুণ শৃঙ্খল কিন্তু খুব পুরনো নয়। বরং কিছুটা সাম্প্রতিক, জোট রাজনীতির যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে এই সব চোরাস্রোতের বাড়াবাড়ির শুরু। সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরে অভূতপূর্ব ঐক্যের ছবি আজও অনেকে গরিমায় স্মরণ করেন। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলি দেশের নানা প্রান্তে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার পর থেকে সে ছবি বদলে গিয়েছে অনেক। আঞ্চলিক রথী-মহারথীদের সম্মিলিত জনভিত্তি কিন্তু দেশের দুই প্রধান জাতীয় দলের চেয়ে খুব একটা কম নয়। কিন্তু পরস্পরের কাছাকাছি না আসার যে বাধ্যবাধকতা এই আঞ্চলিক শক্তিগুলির, তাতেই বিরোধী ঐক্য ভেঙে চৌচির। এতে কখনও সুবিধা বিজেপির, কখনও তা আশীর্বাদ কংগ্রেসের জন্য।

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। ঘোষিত দিনেই রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছেন। শিবসেনার মতো সঙ্গী জুটিয়ে শাসক শিবিরে কিছুমাত্র হলেও ভাঙন ধরিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী ঐক্যের ছবিটা আরও অনেক উজ্জ্বল হতে পারত, যদি ভারতীয় রাজনীতি অগণিত বিরোধাভাসে জর্জরিত না হত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন