আত্মদর্শন: অর্থনীতির স্বাস্থ্য কেমন, তা বুঝতে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। ‘পভার্টি অ্যান্ড ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশন ইন ইন্ডিয়া’ বইটির প্রচ্ছদ।
ভা রতীয়দের জীবনে অনেক আক্ষেপ। তার একটা এই যে, আইএসআই বললে আমরা বুঝি পাক গুপ্তচর সংস্থা। এমনকী কলকাতার মানুষেরও চট করে মনে পড়ে না বরানগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কথা। অথচ ভারত স্বাধীন হওয়ারও আগে এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের কাছে ভারতের অন্যতম পরিচয় ছিল। ১৯৫৬ সালে আসেন চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। বৈঠক শেষ হওয়ার পরেও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে আলোচনা ছেড়ে উঠতে চাননি। কী করে ভারত কম খরচে, কম সময়ে, সরকারি পরিকল্পনার উপযুক্ত পরিসংখ্যান প্রস্তুত করে ফেলতে পারে, চিন কেন পারে না, আইএসআই-এর প্রতিষ্ঠাতার থেকে বুঝতে চাইছিলেন তিনি। সে যুগে বিশ্বের সেরা সংখ্যাতত্ত্ববিদরা কাজ করে গিয়েছেন এখানে। তাঁদের গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে আইএসআই-এর নিজস্ব জার্নাল ‘সংখ্যা’-তে। আজ মহলানবিশকে যদি বা কেউ চিনতে পারে, তা ‘ব্যর্থ’ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার বলে।
অতীত নিয়ে বড়াই করতে আমাদের জুড়ি নেই। তবু আইএসআই বা মহলানবিশ যে আমাদের নজরে পড়ে না, সে আক্ষেপ কেবল গর্ব করার সুযোগ হারানোর দুঃখ নয়। এই বিস্মৃতি আসলে তথ্য ও পরিসংখ্যানের প্রতি আমাদের মনোভাবের পরিচয়। তার প্রমাণ মিলল গত কয়েক সপ্তাহে। ‘বৃদ্ধির হার’ বা ‘গ্রোথ রেট’ আধ শতাংশ বাড়তে নেতা-আমলারা জয়ঢাক বাজাতে লাগলেন। কারও মনে পড়ল না যে ভোগ ব্যয় মাপার যে দু’টি সরকারি সূত্র — জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (এনএসএস) এবং কেন্দ্রীয় সংখ্যাতত্ত্ব সংস্থান (সিএসও) দ্বারা প্রস্তুত মোট জাতীয় উৎপাদন— সে দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প বলছে। এনএসএস মোট জাতীয় উৎপাদন বা জি়ডিপি-র যা সংখ্যা দিচ্ছে, তা সিএসও-র দেওয়া সংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। যদি ধরে নিতে হয় যে দুই সূত্র থেকে পাওয়া দু’টি সংখ্যাই ভুল, তা হলে তেমন সংখ্যায় সামান্য পরিবর্তন আনার জন্য এত হইচইয়ের দরকার কী?
সংখ্যা না বুঝে সংখ্যার উপর নির্ভর করার যে অভ্যাস তৈরি হয়েছে, তার জন্য কী মূল্য চোকাতে হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত নোটবাতিল নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা। নোটবাতিল হওয়া সত্ত্বেও যে ভারতের অর্থনীতি ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, তা নিয়ে অনেক কথা হল সংবাদমাধ্যমে। অর্থনীতি বিষযক সচিব শক্তিকান্ত দাস দাবি করলেন, নোটবাতিলের ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে সব আশঙ্কা শোনা গিয়েছিল, সেগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অথচ যে মন্ত্রকে তিনি কাজ করেন, সেই অর্থ মন্ত্রকই গত মাসে ‘অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ প্রকাশ করেছে। অত্যুৎকৃষ্ট রিপোর্টখানা বলে দিচ্ছে, কী করে ওই বৃদ্ধির হার পাওয়া গেল। বলা হচ্ছে, ‘২০১৭ আর্থিক বর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে মোট জাতীয় উৎপাদনে বৃদ্ধির যে হার নথিভুক্ত হয়েছে তাতে নোটবাতিলের সামগ্রিক প্রভাবের অল্পই ধরা পড়বে, কারণ অর্থনীতির যে অংশগুলি (অসংগঠিত এবং নগদ-নির্ভর) সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলো জাতীয় আয়ের হিসাবে হয় ধরা পড়েনি, নয়তো তার পরিমাপ হয়েছে সংগঠিত ক্ষেত্রের সূচক দিয়ে। যেমন অসংগঠিত শিল্পে উৎপাদনের হিসেব করতে বিকল্প হিসেবে নেওয়া হয়েছে সংগঠিত শিল্পে উৎপাদনের সূচক, যার মধ্যে বৃহৎ শিল্পই বেশি। তাই উৎপাদন বা জোগানের নিরিখে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর নোটবাতিলের প্রভাবের আন্দাজ বাস্তবের চাইতে কম দেখাবে। অংসগঠিত ক্ষেত্রের উপর প্রভাব বোঝা যাবে সংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা থেকে, কারণ আয় কমলে চাহিদা কমবে।’
এই বক্তব্য একেবারে যথাযথ। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সত্যিই বড় ক্ষতি হয়েেছে কি না, সে বিষয়ে আমরা এখনও কিছুই নিশ্চিত ভাবে জানি না। সমস্যা হল, তথ্যের এই অভাবের ফলে আমাদের অর্থনীতির কী হচ্ছে, ভাল না মন্দ, কিছুই যে বোঝা সম্ভব নয়, তা আমাদের নেতারা হয় জানেন না, না হলে জানতে চান না। তাই ভারতবর্ষ, যা এক সময়ে পরিসংখ্যানের মানের উৎকর্ষে গোটা বিশ্বে নেতৃত্বের স্থানে ছিল, তা এখন পিছিয়ে পড়ছে। আমরা ভুলে গিয়েছি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পরিচালনায় ১৯৪৯ সালে যে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা— যেখানে দেশের বাছাই-করা আঠারোশো গ্রামে এক লক্ষের উপর গৃহস্থালিতে গিয়ে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়েছিল— তেমন বিপুল সমীক্ষা গোটা বিশ্বে ছিল সেই প্রথম। সেই সমীক্ষার পদ্ধতি গোটা বিশ্বে গৃহস্থালি সমীক্ষার মডেল হয়ে উঠেছিল। কোনও সমীক্ষার ফল কতটা নির্ভরযোগ্য, তা বুঝতে মহলানবিশ ১৯৩৬ সালে যে পদ্ধতি বার করেছিলেন, তা আজও যে কোনও সমীক্ষার নকশায় ব্যবহার করা হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জীবনযাপনের মান নির্ণয়ের জন্য নানা দেশে যে সমীক্ষা করে, তা-ও জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে পাওয়া। অথচ আজ যখন অর্থনীতিকরা উৎকৃষ্ট পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করেন, তখন ভারতের নাম উচ্চারিত হয় না। আসে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কেনিয়া, চিন, এমনকী পাকিস্তানের নাম।
এই আত্মবিস্মৃতির দিকে নজর টানতেই সম্প্রতি সত্তরের দশকে আইএসআই-প্রকাশিত একটি প্রবন্ধসংগ্রহ পুনর্মুদ্রিত হল। ‘পভার্টি অ্যান্ড ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশন ইন ইন্ডিয়া’ (জগরনট, দিল্লি, ২০১৭, সম্পাদনা প্রণব বর্ধন, টিএন শ্রীনিবাসন, রোহিণী সোমনাথন ও অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়) নামে এই বইটির উদ্দেশ্য কিছু অসামান্য প্রবন্ধকে ফের আলোয় নিয়ে আসা। দারিদ্র এবং অসাম্যকে কী করে পরিসংখ্যানে প্রকাশ করা যায়, মাপা যায়, এবং তার ভিত্তিতে কতটুকু কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে এই বই। পড়লে বেশ বোঝা যায়, কী করে পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও একত্রিত করতে হয় তার প্রতি গবেষকদের কত সূক্ষ্ম, সযত্ন মনোযোগ। সমীক্ষা থেকে যে তথ্য মেলে, তার সীমাবদ্ধতা এবং আস্থাভাজনতা সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টি কতটা স্বচ্ছ, সতর্ক। তাঁরা দারিদ্র কমানোর বিভিন্ন নীতি সমর্থন করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন কোথায় কী ভুল হতে পারে। এবং কোন প্রশ্নগুলির উত্তর অজানা।
অসাম্য ও দারিদ্রচর্চা ফের ফ্যাশনদুরস্ত হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে যে কোনও বক্তব্যের পিছনে রয়েছে যে তথ্য-পরিসংখ্যান, তার প্রতি আগের মতো সপ্রশ্ন সম্মান দেখাই যায় না। অতীত গৌরবময়, বর্তমান লজ্জার, তা মনে করানোর জন্য এই বই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে অর্থনীতির শিক্ষক