Scientific Topics

কথা ও সুর

পশ্চিমবঙ্গের লোকবৃত্তে ভাষাভঙ্গি এবং সুর গত কয়েক দশকে কতখানি পাল্টে গিয়েছে, সে-কথা বহু নাগরিকের ব্যক্তিগত স্মৃতিতেই স্পষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ ০৫:৩৩
Share:

বিবিধের মাঝে মিলন মহান, সে তো অনেক দিনের চেনা কথা, তার সুরটিও অতিপরিচিত। সেই গানের বাণী আজ কতখানি দামি, সেটাও কারও অজানা নয়। কিন্তু মনোবিজ্ঞান, সঙ্গীতশাস্ত্র, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিদ্যার সন্ধানী প্রায় চল্লিশ জন গবেষক সমবেত উদ্যোগে এই গ্রহের অধিবাসীদের কথায় ও সুরে বিবিধের মাঝে মিলনের এক নতুন পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন। সেই মিলনকে মহান বললে বেশি বলা হবে, কিন্তু তা অবশ্যই অতি মধুর মিলন। আমেরিকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষকরা ছ’টি মহাদেশের আঠারোটি ভাষাভাষী চারশোর বেশি মানুষের কথা শুনেছেন এবং তার বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা সবাই বাবা অথবা মা, কথাগুলি তাঁরা বলেছেন সন্তানের সঙ্গে। বাঘা বাইনের ভাষায় ‘কচি তারা, কথা ফোটে না’ যে দুধের শিশুরা, সন্ধানীরা খতিয়ে দেখেছেন, তাদের আদর করার সময় মা-বাবা যে স্নেহময় কথা বা ধ্বনি উচ্চারণ করেন, সেগুলির সুরে ও বাগ্‌ভঙ্গিতে আশ্চর্য মিল। বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁদের কথা ও সুর একেবারে অন্য। দুনিয়ার অন্য নানা অঞ্চলের মানুষকে তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনিয়ে দেখা গিয়েছে, ভাষার বিন্দুবিসর্গ না-জানলেও কোনটি শিশুর প্রতি সম্ভাষণ, সেটা শ্রোতারা ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল চিনে নিতে পেরেছেন।

Advertisement

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এর জন্য আর গবেষণার কী দরকার, এ তো হবেই। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে জাতিগোষ্ঠী বা ভাষা নির্বিশেষে মানুষ শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময় একই ধরনের বাগ্‌ভঙ্গি অনুশীলন করেন— এমন একটি তথ্য সংশ্লিষ্ট নানা বিজ্ঞানের মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে, কারণ মানুষের আচরণে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রভাব এতটাই বেশি যে, সংস্কৃতি-নিরপেক্ষ আচরণের নজির দুর্লভ বললে কম বলা হয়, তেমন নজির মিললে সমগ্র মানবজাতির অন্তর্নিহিত স্বভাবের ধারণাটি সম্পর্কে কিছু আভাস মিলতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিজ্ঞানীরা এমন বড় আকারে সমীক্ষার আয়োজন করেছিলেন। ফলাফল দেখে তাঁরা চমৎকৃত। কেন এই মিল? কেন নানা দেশের নানা জনগোষ্ঠীর নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ শিশুদের সঙ্গে একই ভাবে ‘কথা’ বলেন? স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা চড়া পর্দায়, স্বাভাবিক স্বরের তুলনায় কিছুটা সুরেলা ভঙ্গিতে, আদুরে গলায়? যথেষ্ট সন্তোষজনক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, সমীক্ষার ফলকে নানা দিক থেকে বিচার করে, প্রয়োজনে আরও অনেক সমীক্ষা চালিয়ে সেই উত্তর সন্ধান করবেন গবেষকরা। বিজ্ঞান এ ভাবেই অগ্রসর হয়, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক গুরুদের মতো সব প্রশ্নের হাজির জবাব তার কাছে নেই, সেই জবাব দেওয়ার দায়ও তার নেই। তবে প্রাথমিক অনুমান বিজ্ঞানের স্বাভাবিক অঙ্গ। সেই অনুমানের ভিত্তিতে বলা যায়, বড়দের এই ধরনের বাগ্‌ভঙ্গিতে, কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে এবং মধুর সুরে শিশুরা স্বস্তি পায়, আশ্বাস পায়, ভরসা পায়। ঠিক যেমন প্রচণ্ড ধমকের সুরে কর্কশ কণ্ঠে কথা বললে দুধের শিশুও সচরাচর ভয় পায়, বিভ্রান্ত হয়, সম্ভবত গভীর উদ্বেগ বোধ করে। সাধারণ বুদ্ধিও তেমনই বলে বইকি।

বিজ্ঞানীদের কাজ তাঁরা করবেন, সাধারণ বুদ্ধির দৌড় সীমিত, এবং তাকে সীমিত রাখাই শ্রেয়। কেবল শিশুর সঙ্গে বড়দের স্নেহময় আলাপের এই সর্বজনীন চরিত্রটির সূত্র ধরে একটি কথা ভাবা যেতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক মানুষের আলাপের সুরে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে, এমনকি একই পরিসরে বিভিন্ন সময়ে বা প্রসঙ্গে বিপুল পার্থক্য। এই পার্থক্যের একটি বড় কারণ অবশ্যই সামাজিক অবস্থান— একই ব্যক্তি উচ্চতর সামাজিক অবস্থানের মানুষের সঙ্গে যে ভঙ্গিতে বা সুরে কথা বলেন, সচরাচর সমকক্ষ বা নিম্নবর্তীদের সঙ্গে সেই ভাবে বলেন না। কিন্তু সেই তফাত সরিয়ে রেখে সামগ্রিক ছবিটার দিকে তাকালেও দেখা যাবে, একটা সমাজ থেকে আর একটা সমাজে পারস্পরিক আলাপের সুরে বড় রকমের ফারাক হয়, ঠিক যেমন একই সমাজে কালক্রমে সেই সুর পাল্টে যায়। পশ্চিমবঙ্গের লোকবৃত্তে ভাষাভঙ্গি এবং সুর গত কয়েক দশকে কতখানি পাল্টে গিয়েছে, সে-কথা বহু নাগরিকের ব্যক্তিগত স্মৃতিতেই স্পষ্ট। আরও পিছিয়ে যেতে চাইলে কিছু কিছু নথি সেই কাজে লাগানো যেতেই পারে, বিশেষত বাংলা চলচ্চিত্রের ভান্ডারটি এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। কথা এবং সুরের এই পরিবর্তন উৎকৃষ্ট সমীক্ষার বিষয় হতে পারে। কেবল কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য নয়, সমাজকে বোঝার পক্ষেও তার মূল্য অনেক।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন