বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থির, অশান্ত সময়ের উদাহরণ কম নয়। কিন্তু যে কোনও হিসাবে, যে কোনও মানদণ্ডেই একেবারে শীর্ষে জায়গা নেবে আজকের পরিস্থিতি। উগ্র ধর্মান্ধ হিংসার একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে সেখানে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে চরম ভারতবিদ্বেষের অন্ধতা। ‘হিংসা’ বা ‘অন্ধতা’— শব্দগুলি অনেক সময় আলগা ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে শব্দগুলি ধ্বনিতে ধ্বনিতে সত্য। যে ভাবে ময়মনসিংহে এক হিন্দু তরুণকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে চূড়ান্ত শারীরিক নিগ্রহ ও নিধনের পর আগুনে পুড়িয়ে মারা হল, সর্বসমক্ষে, জনোল্লাসের আবহে— তার তুল্য চূড়ান্ত অমানবিকতা এই উপমহাদেশ কত বারই বা দেখেছে! যে ভাবে সে দেশের দুই সংবাদ প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ও ডেলি স্টার-এর উপর, ও ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানট-এর উপর ভয়ঙ্কর হামলা ও অগ্নিসংযোগ হল, সংবাদপত্র অফিসে প্রাণসংশয়ের মুখে পড়লেন কর্মীরা— দেশবিদেশে তা ত্রাসের শিহরন জাগাল। ঢাকা এবং অন্যত্র যে ভাবে ভারতের মাথা কেটে নেওয়ার স্লোগান তুলে পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ, ভারতীয় হাই কমিশন ও ডেপুটি হাই কমিশন ঘেরাও করলেন, তার প্রেক্ষিতেও অন্ধতা কথাটি আর আলঙ্কারিক নয়। চরম দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে, উগ্র গোষ্ঠীগুলির বাধা সত্ত্বেও যে দিন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ঘোষিত হল, তার ঠিক পরেই বাংলাদেশ ভেসে গেল ঘোর ফেনিল সঙ্কটাবর্তে।
ঘটনার সূত্র, গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায়, ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম হোতা ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার পর সিঙ্গাপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। অতি দুর্ভাগ্যজনক, চরম নিন্দার্হ এই কাজে কে বা কারা অপরাধী, তাদের খুঁজে বার করা জরুরি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। যদি তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার করে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাদের সন্ধান করা জরুরি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মান্য করে। ইতিহাসে বহু দেশে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, ফলে কিছু সর্বমান্য রীতিনীতি অবশ্যই আছে। কিন্তু তার বদলে— অপরাধী ভারতে পালিয়েছে মানেই ভারতের এ বিষয়ে হাত আছে, এই অতিসরল স্লোগানে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যক্রমে সাধারণ মানুষকে তাতিয়ে তোলা, অবারিত ধ্বংসকাণ্ডে প্রশ্রয় ও প্ররোচনা দেওয়া, এবং ভারতের প্রতি ক্রোধান্ধতায় সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের প্রতি নির্যাতন— অক্ষমণীয়।
এই সব অক্ষমণীয় ঘটনা বন্ধ করার দায়িত্বটি যাঁর ও যাঁদের— সেই অন্তর্বর্তিকালীন সরকার ও তার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস মোটের উপর নিস্পৃহতায় ও নিষ্ক্রিয়তায় দেখে চলেছেন, কোন অতলে ডুবতে পারে বাংলাদেশ। ইউনূস রুটিন বার্তা দিয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অথচ সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপে এই ‘মব’-হিংসা নিশ্চয় থামানো যেত। অন্তত সংবাদমাধ্যম অফিসগুলির উপর হামলা বা ছায়ানটের উপর বর্বর আক্রমণের ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হওয়া যেত। পরিবর্তে যা দেখা গেল, তাতে সংশয় স্বাভাবিক, গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তিকালীন সরকার যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করে, এ বার উপস্থিত তার পরবর্তী অধ্যায়। সেই জন্যই এত হাজার মানুষ— যাঁদের মধ্যে মুক্তচিন্তার সাংবাদিকরাও আছেন— গ্রেফতার হলেন গত ক’দিনে। অর্থাৎ, হিংসার অভিযোগে পূর্বতন শাসককে সরিয়েছেন যাঁরা, তাঁরাও একই হিংসায়, এমনকি আরও বেশি নিষ্ঠুরতায় সরকারি সিলমোহর দিচ্ছেন। এ তো কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, উগ্র ইসলামি হিংসা, যার অভিঘাত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতকেও ঘোর বিপন্ন করতে পারে। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সুস্থ সংস্কৃতি ও রাজনীতির সমস্ত অর্জনকে মুছে দিতে প্রবৃত্ত ক্রোধোন্মত্ত জনতা ও ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী নেতৃত্ব এই ভাবেই সমগ্র উপমহাদেশকে বিপন্ন করছেন।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে