—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নারীকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রচারের হ্যালোজেনের পাশেই বয়ে যায় অন্ধকারের খরস্রোতা। সমীক্ষা জানিয়েছে, বছরে ১০ লক্ষেরও বেশি নারী ও শিশু পাচার হয় ভারত থেকে। আর, এই অপরাধে শীর্ষস্থানে পশ্চিমবঙ্গ। বড় শহরগুলি যেমন পাচারের কেন্দ্র, তেমনই দুই ২৪ পরগনা, দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদের মতো জেলা থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির নারী ও শিশুদের মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে— বহু বার উঠে আসা এই উদ্বেগের প্রমাণ মিলল আবারও। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পাচার চক্রের সক্রিয়তার খবর আগেই ছিল। এ বার বারাসত জেলা পুলিশ এমন চক্রের হদিস পেল, যারা আয়া সেন্টারে কাজ দেওয়ার ছলনায় অল্পবয়সি মেয়েদের এলাকার বিভিন্ন হোটেল ও স্পায়ে দেহব্যবসায় বাধ্য করছিল। এই পরিসংখ্যান, এই গ্রেফতারি হিমশৈলের চূড়া। বহু ‘নিখোঁজ’ মেয়েদেরই খবর প্রকাশ্যে আসে না। লোকলজ্জার আতঙ্কে পরিবার তথ্য লুকোয়, আইনে অজ্ঞতা ও ভয়ে মেয়েরা চুপ থাকে। কারণ নারীঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে দোষীকে ছাড় দিয়ে ভুক্তভোগীকে কোণঠাসা করাই দেশের মজ্জাগত। ফলে, শাস্তি অধরা থাকে, প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারকের যোগসাজশের সন্দেহ বাড়ে এবং প্রখর এই নৈঃশব্দ্যের সুযোগে দুর্বল অর্থনীতির দেশে বিপুল অসাংগঠনিক ক্ষেত্রে অপরাধ বাড়ে নিরুপদ্রবে।
নকল বিয়ে বা প্রেমের অভিনয় তো রয়েইছে, সমান ভয়ঙ্কর ভুয়ো নিয়োগ সংস্থা, যারা অনলাইনে বা ঘরের আশপাশে বিজ্ঞাপন বা দালালের মাধ্যমে ফাঁদ পাতে। অন্য দিকে, সমাজ কেবলই নানা ভাবে ঘরে-বাইরে মেয়েদের বঞ্চিত করে, নির্যাতন, হিংসা সীমা ছাড়ায়। মুক্তি স্বনির্ভরতায়। কিন্তু শিক্ষার আলো থেকে বহু দূরে যাঁরা, তাঁরা বেকারত্বের বাজারে কাজ জোগাড় করতে হিমশিম খান। তখনই দুর্বৃত্তরা নিয়োগকারী সেজে বিউটি পার্লারে, ফ্যাশনশিল্প বা চলচ্চিত্রে, কারখানায়, গার্হস্থ শ্রমে ভাল উপার্জন ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায় ও মেয়েদের বাড়ির আশ্রয় থেকে বার করে দেহব্যবসা ও নানা বেআইনি শ্রমে যুক্ত করে। শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের সঙ্গে খোয়া যায় মৌলিক মানবাধিকারগুলিও। গহ্বর থেকে উদ্ধার করা গেলেও, দেখা গিয়েছে উপযুক্ত পুনর্বাসনের অভাবে তাঁরা আর পরিবার ও সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারেন না। আইনি সহায়তা সম্পর্কে জানা না থাকায় মেলে না দ্রুত সুবিচারও, ফের চক্রের সজাগ হওয়ার ও অত্যাচারের অন্ধকূপে পুনর্নিক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। পরিস্থিতির ক্রম অবনতির জন্য দায়ী কোভিড-পরবর্তী সমাজমাধ্যমের বাড়বৃদ্ধি।
সামাজিক নীরবতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তাকে ভাঙতে হবে। উপার্জনের বিভিন্ন পথ, শ্রম আইন সম্পর্কে সচেতনতা, নিয়োগকারী সংস্থার কোন নথি যাচাই করা জরুরি এবং সন্দেহের চিহ্ন কোনগুলি— তুমুল প্রচার চালাতে হবে পাড়ায়, স্কুল-কলেজে। যাতে নিজে সুরক্ষিত থাকার সঙ্গে অন্য কেউ, বিশেষত নাবালিকারা বিপদে পড়ছে কি না— সতর্ক থাকা যায়। ভুক্তভোগীকে জীবন পুনর্গঠনে সর্বপ্রকার সহায়তা করতে হবে। কিছু ধরপাকড়ই যথেষ্ট নয়, কঠোর শাস্তি সুনিশ্চিত করার সঙ্গে নারীকে নিরাপত্তা দিতে হবে প্রশাসনকে, সমাজকে। সুস্থ সমাজে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিধান, তার শোষণ ও ত্রাসের উৎস হয়ে ওঠার এই প্রবণতা মারাত্মক, কলঙ্কস্বরূপ।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে