Dattatreya Hosabale

আর সংখ্যালঘু নাই!

আরএসএসের এই বাণী শুনে ইতিহাসমনস্ক নাগরিক ফিরে যেতে পারেন স্বাধীন ভারতের প্রত্যুষে। সংবিধানের বয়স তখন মাত্র কয়েক মাস। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি পক্ষে চিঠি লিখতেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ০৮:০০
Share:

— ফাইল চিত্র।

গণতন্ত্রের মোড়কে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য জারি করার প্রকল্প নিয়ে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার-শাসিত ভারতে নতুন করে কিছু বলার থাকতে পারে, সাধারণ বুদ্ধিতে এমনটা ভাবা সহজ নয়। কিন্তু সঙ্ঘাধীশদের উদ্ভাবনী শক্তি বাস্তবিক অসাধারণ। তাঁরা নতুন বোতলে পুরনো অমৃত সরবরাহ করে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নন, পানীয়ের অনুপান বদলে নিতেও তাঁদের জুড়ি নেই। অতএব, আরও তিন বছরের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরে এসে দত্তাত্রেয় হোসাবলে ঘোষণা করেছেন: সংখ্যালঘু সম্পর্কিত ধারণাটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। কথাটিতে আপাতবিচারে আপত্তির কিছু নেই— সব ধারণাই যে পুনর্বিবেচনার যোগ্য, মৌলবাদী ছাড়া সকলেই সে-কথা মানবেন। কিন্তু গূঢ় প্রশ্ন হল: পুনর্বিবেচনার উদ্দেশ্য কী? শ্রীযুক্ত হোসাবলের সুসমাচারটি তাৎপর্যপূর্ণ: “যখন কাউকে সংখ্যালঘু বলা হয়, তখন সমাজে বিভাজন তৈরি করা হয়।” অর্থাৎ, অতঃপর সংখ্যালঘু নামক ধারণাটিই তাঁরা বাতিল করতে উদ্যোগী হবেন। উদয়ন পণ্ডিতের বিদ্যায়তনের সামনে দাঁড়িয়ে হীরক রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন: আর পাঠশালা নাই। আরএসএসের সাধারণ সম্পাদকের কথাটির মর্মার্থ: আর সংখ্যালঘু নাই।

Advertisement

আরএসএসের এই বাণী শুনে ইতিহাসমনস্ক নাগরিক ফিরে যেতে পারেন স্বাধীন ভারতের প্রত্যুষে। সংবিধানের বয়স তখন মাত্র কয়েক মাস। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি পক্ষে চিঠি লিখতেন। ১৯৫০ সালের ২ জুলাই লেখা চিঠিতে তিনি জোর দিয়েছিলেন ভারতে (এবং পাকিস্তানে) সংখ্যালঘুর প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্বের উপর। তাঁর মতে, সংখ্যালঘু সমস্যার অনেক মাত্রা আছে, কিন্তু “প্রধানতম মাত্রাটি হল মনস্তাত্ত্বিক”— সংখ্যালঘু মানুষ যেন স্বাধীন দেশে নিরাপত্তার কোনও অভাব বোধ না করেন, তাঁরা যেন দেশের নাগরিক হিসাবে সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করেন। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা এবং বজায় রাখাই স্বাধীন দেশের দায়। সেই দায় কেবল প্রশাসনের নয়, সমাজেরও, বিশেষত সংখ্যাগুরু সমাজের। এই ভাবনা কেবল একটি চিঠির নয়, কেবল এক জন প্রধানমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রনায়কের নয়, ভারত নামক দেশটির কাঙ্ক্ষিত শাসনতন্ত্র এবং সমাজকাঠামোর মর্মকথা হিসাবেই সে-দিন মর্যাদা পেয়েছিল। পরবর্তী কালে এই আদর্শ ক্রমাগত লাঞ্ছিত হয়েছে, স্বয়ং নেহরুর সময় থেকেই সংখ্যালঘুর যথার্থ অধিকার অর্জনের লক্ষ্য ক্রমশ পিছু হটেছে, তার জায়গায় সংখ্যালঘুকে ক্ষুদ্রস্বার্থ-সর্বস্ব রাজনীতির উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই লজ্জাকর ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর দায় বিপুল। কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রতিপত্তি গড়ে ওঠার আগে অবধি সংখ্যালঘুর রক্ষাকবচ নিশ্চিত করার ধারণাটি— আদর্শ হিসাবে— সাধারণ ভাবে সম্মানিত ছিল।

বর্তমান শাসকরা সেই আদর্শকেই অস্বীকার করেন। তাঁদের রাজনৈতিক প্রকল্পে সংখ্যালঘুর ভূমিকা প্রধানত দ্বিমাত্রিক। এক দিকে, তাকে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া করে সংখ্যাগুরু শিবিরটিকে প্রসারিত এবং সংহত করার অভিযান চলেছে দুর্বার গতিতে। অন্য দিকে, তাকে সমস্ত নিজস্বতা এবং স্বাধিকার বিসর্জন দিয়ে সংখ্যাগুরুর অধীনে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির অর্ধ-নাগরিক অস্তিত্ব মেনে নিতে বলা হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বোধ করি এখন নতুন মন্ত্রপাঠ শুরু হল: সংখ্যালঘুর ধারণাটিই বাতিল করতে হবে। স্বাধীনতার আট দশক পরেও যে দেশের আইনসভায়, প্রশাসনে, ব্যবসাবাণিজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সর্বত্র সংখ্যালঘুরা সর্ব অর্থেই সংখ্যালঘু, যে দেশের শাসক দলের সাতমহলা পরিসরে সংখ্যালঘুকে আতশকাচ দিয়ে খুঁজতে হয়, সেখানে ওই শাসক শিবিরের চিন্তানায়করা অম্লানবদনে বলছেন: কাউকে সংখ্যালঘু বললে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়! বিচিত্র বটে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন