Gandhi Peace Price

অন্তঃসারশূন্য

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটি ‘গান্ধীবাদী পথ’-এ সমাজের উন্নতিসাধনে বিশেষ অবদানের জন্য গীতা প্রেসকে গান্ধী শান্তি পুরস্কারের যোগ্য বিবেচনা করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৩ ০৬:১৩
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

গান্ধী শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, এই সংবাদে কি আনন্দিত হতেন শতাব্দীপ্রাচীন গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা জয়দয়াল গোয়ান্দকা, বা এই প্রকাশনা সংস্থার পত্রিকা কল্যাণ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হনুমান প্রসাদ পোদ্দার? গান্ধীর সঙ্গে গীতা প্রেসের সম্পর্ক ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে— ১৯২৬ সালে কল্যাণ পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে গোয়ান্দকা ও পোদ্দার গান্ধীর আশীর্বাদ নিয়েছিলেন; ১৯৪৮ সালে গান্ধী-হত্যার পর দেশ জুড়ে যত লোক গ্রেফতার হয়েছিলেন, সেই তালিকাতে ছিল এই দু’জনের নামও। গান্ধীহত্যার অভিযোগে হাজতবাসের পর মুক্তি পেয়ে মাধব গোলওয়ালকর বারাণসী এলে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার হোতাও ছিলেন পোদ্দার। ১৯৩০-এর দশক থেকেই গান্ধীর প্রতি গীতা প্রেসের মনোভাব নেতিবাচক হতে থাকে। সেই বিরোধের কেন্দ্রে ছিল এই দ্বন্দ্ব— জাতপাতের প্রশ্নে গান্ধী যে অবস্থান গ্রহণ করছেন, তা কি সনাতন ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? ১৯৩২ সালে কল্যাণ-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘অস্পৃশ্য’দের মন্দিরে প্রবেশ, ‘উচ্চ’ জাতের সঙ্গে একত্রে খাওয়াদাওয়া ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেছিল, এই ‘নিম্ন’বর্ণের মানুষদের যদি ‘শুদ্ধিকরণ’ না ঘটে, তা হলে কি তাঁদের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব? তার দেড় দশক পরে, ১৯৪৬ সালে, এক বিবাহের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছিলেন এক হরিজন; গান্ধী সেই ঘটনায় নিজের সমর্থন জানিয়েছিলেন। কল্যাণ-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে পোদ্দার লিখেছিলেন, “গান্ধীর আচরণে হিন্দুধর্মের বিরোধীরা মদত পাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, গান্ধী নিজেকে সনাতনি হিন্দু মনে করেন, বিবাহের প্রথার প্রতি তাঁর আস্থা আছে, অথচ তিনি এমন অ-শাস্ত্রীয় কাজকর্মকে মদত দেন।”

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটি ‘গান্ধীবাদী পথ’-এ সমাজের উন্নতিসাধনে বিশেষ অবদানের জন্য গীতা প্রেসকে গান্ধী শান্তি পুরস্কারের যোগ্য বিবেচনা করেছে। অদৃষ্টের বিপুল পরিহাস, কারণ গীতা প্রেসের সঙ্গে গান্ধীর মতবিরোধ যে বিন্দুতে, ‘গান্ধীবাদী’ চিন্তায় তার অবস্থান কেন্দ্রীয়। সঙ্ঘ পরিবার বা হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে গান্ধীর বিরোধ যেখানে, গীতা প্রেসের সঙ্গেও বিরোধ সেখানেই— গোলওয়ালকরের মতে যে জাতপাত প্রথা হিন্দু সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ, গান্ধী তাকে হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হিসাবে দেখেছিলেন। পোদ্দার তাঁর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, গান্ধী হলেন ভারতীয় বেশভূষায় এক পাশ্চাত্য সাধু— তাঁর বহু ধ্যানধারণার সঙ্গে পোদ্দার একমত নন, এবং গান্ধীর কিছু কথা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। শুধু পোদ্দারের কাছেই নয়, সব হিন্দু জাতীয়তাবাদীর কাছেই গান্ধীর কিছু কথা অগ্রহণযোগ্য— কারণ, বাইরে থেকে আক্রমণ করে নয়, গান্ধী হিন্দু ধর্মের অন্ধকারগুলিকে মুছতে চেয়েছিলেন ধর্মের ভিতর থেকে।

হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের সুখস্বপ্নে এখনও গান্ধী বড় বাধা। কিন্তু, নেহরুর ক্ষেত্রে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব যেমন প্রত্যক্ষ সমরে নেমেছেন, গান্ধীর ক্ষেত্রে রণকৌশলটি পৃথক— নরেন্দ্র মোদীরা গান্ধীকে তাঁর রাজনীতি, তাঁর আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে কিছু অন্তঃসারশূন্য প্রতীকে আবদ্ধ করতে চান। গান্ধী মানে স্বচ্ছতা বটে— তিনি নিজের হাতে শৌচাগার পরিষ্কার করেছেন— কিন্তু, সেই স্বচ্ছতা যে শুধুমাত্র বহিরঙ্গের নয়, অন্তরকে স্বচ্ছ করার প্রক্রিয়ার একটি রূপ মাত্র, ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের প্রতীক হিসাবে গান্ধীর চশমাটি নেওয়ার সময় নেতারা এই কথাটি বিলকুল চেপে যান। তেমনই, গান্ধীবাদী আদর্শ যে শুধুমাত্র বহিরঙ্গের হিংসা বর্জন নয়, অ-পরের প্রতি ঘৃণার হিংসাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা, সে কথা স্বীকার করা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে অসম্ভব। তাঁরা গান্ধীকে ব্যবহার করতে চান, কিন্তু তাঁর আদর্শের প্রতি অনুগত থাকতে নয়। গীতা প্রেসকে গান্ধীর নামাঙ্কিত পুরস্কার দেওয়া তাৎপর্যপূর্ণ— যে প্রতিষ্ঠান গান্ধীর আদর্শকে অস্বীকার করে, তাকে এই পুরস্কার দিলে গান্ধীকে অর্থহীন করে তোলার কাজটি সুসম্পন্ন হয় বটে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন