Central Government

মুচলেকা

দিল্লীশ্বর ও তাঁর পারিষদবর্গ ভুলেছেন যে, সাহিত্য অকাদেমি বা অন্য কোনও পুরস্কারই রাজদরবারে দেওয়া পারিতোষিক নয় লেখক বা শিল্পীকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র বা কোনও সংস্থা নিজে গৌরবান্বিত হতে চায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৩ ০৭:২৩
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

স‌ংসদীয় প্যানেল বিস্তর ভাবনাচিন্তার পর ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি’ ঠেকানোর পথ বার করেছে— অকাদেমি পুরস্কার দেওয়ার আগেই প্রাপকদের থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হোক যে, কোনও অবস্থাতেই তাঁরা এই পুরস্কার ফিরিয়ে দেবেন না। সরকারের মতে, কোনও প্রাপক পরে পুরস্কার ফিরিয়ে দিলে তাতে অন্য প্রাপকদের অসম্মান, দেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি। মাননীয় সাংসদরা যখন দেশ ও পুরস্কারের সম্মান নিয়ে এতই ভাবিত, তখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে— মুচলেকা দিয়ে পুরস্কার নিতে হবে, এমন একটি কথা উচ্চারণ করাও কতখানি অসম্মানের, তাঁরা ভেবে দেখেছেন কি? দুর্জনে হয়তো বলবে, মুচলেকার প্রতি বর্তমান শাসকদের একটি ঐতিহাসিক দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু সে কথা থাক। দিল্লীশ্বর ও তাঁর পারিষদবর্গ ভুলেছেন যে, সাহিত্য অকাদেমি বা অন্য কোনও পুরস্কারই রাজদরবারে দেওয়া পারিতোষিক নয়— লেখক বা শিল্পীকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র বা কোনও সংস্থা নিজে গৌরবান্বিত হতে চায়। এই কথাটি বোঝার জন্য বোধের যে গভীরতা প্রয়োজন, আশঙ্কা হয়, তাকে স্পর্শ করার পথ ক্ষমতার দম্ভ বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু, অকাদেমি পুরস্কারটি যে আদৌ সরকারি পুরস্কার নয়, সাহিত্য অকাদেমি প্রতিষ্ঠানটি তার গঠনতন্ত্র অনুসারেই স্বতন্ত্র স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান, যার পরিচালনা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে সরকার দূরে থাকবে— এই কথাটি জেনে নিতে তো বোধেরও প্রয়োজন নেই, কিছু ফাইল ঘাঁটাই যথেষ্ট। কেন্দ্রে সরকার গঠন করা আর দেশের রাজা হয়ে সিংহাসনে বসার মধ্যে যে প্রকট এবং অলঙ্ঘ্য ফারাক রয়েছে, বর্তমান সরকার সেই কথাটি সচেতন ভাবে গুলিয়ে দিতে চায়। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিষয়ে অনধিকারচর্চা তার আরও একটি নিদর্শন।

Advertisement

কর্তৃত্ববাদী শাসক মানসম্মান বলতে যা বোঝেন, তার সঙ্গে গণতন্ত্রের পরিসরে সম্মানের ধারণার ফারাক থাকাই স্বাভাবিক। একের পর এক উদারবাদী বিশিষ্ট লেখককে হত্যার পরেও সাহিত্য অকাদেমি সেই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান গ্রহণ না করায় যে লেখকরা পুরস্কার ত্যাগ করেছিলেন, বিশ্বের দরবারে তাঁরা ভারতের সম্মান নষ্ট করেননি, বাড়িয়েছিলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট হয়েছিল, খুদকুঁড়োর লোভে ক্ষমতার সামনে নতজানু হতে নয়, তাঁরা গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার জন্য ক্ষমতার চোখে চোখ রাখতে প্রস্তুত। বিদ্বৎসমাজের কাছে গণতন্ত্র এই ঋজুতাই প্রত্যাশা করে। গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা হয়তো জানেন না, হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন যে, জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাইটহুড ত্যাগ করা ছিল এমনই একটি ঘটনা, যেখানে কবির অবস্থান বিশ্বের চোখে ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যায়কে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।

ভারতের বর্তমান শাসকরা বারে বারেই ভুলিয়ে দিতে চান যে, দেশ আর দেশের শাসক এক নয়। দেশের প্রতি সর্বোচ্চ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা থাকলে তবেই কোনও নাগরিক শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করতে পারেন— কারণ, শাসকের অন্যায় থেকে দেশকে রক্ষা করা সচেতন নাগরিকেরই কর্তব্য। কেউ কোনও পুরস্কার গ্রহণ করবেন কি না, অথবা প্রথমে গ্রহণ করলেও পরে তা ফিরিয়ে দেবেন কি না, তা সেই ব্যক্তিবিশেষের সিদ্ধান্ত। কিন্তু, ২৬ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক যদি একটি নির্দিষ্ট কারণে পুরস্কার ফিরিয়ে দেন, তবে সেই কারণটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয় ছিল। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির হাতে উদারবাদী লেখকের নিধন যে দেশের আত্মার প্রতি আঘাত, এ কথাটি স্বীকার করা উচিত ছিল। মুচলেকা যদি দিতেই হয়, তা দেওয়া কর্তব্য সরকারের। প্রতিটি নাগরিকের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানানো উচিত, সহিষ্ণু গ্রহণশীল বহুত্ববাদী উদার ভারতের আত্মাকে উগ্রপন্থার হাত থেকে রক্ষা করতে যা কিছু করার, সরকার তাতে পিছপা হবে না। অবশ্য, সরকারে শপথ নেওয়ার সময় তাঁরা কি এই প্রতিশ্রুতি দেননি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন