Bengali People

বীরের ধর্ম

বাঙালি বীর কি না, এই প্রশ্নও মাঝে-মাঝে উচ্চারিত হয়। বাঙালির বীরত্বের নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য তখন শত্রু নিকাশকারী আস্ফালনক্ষম মানুষের খোঁজ চলে। না পেলে সবাই ভাবে বাঙালি বীর নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৫০
Share:

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই নজরুলের মতো এমন বীরেরা আছেন। —ফাইল চিত্র।

বীরত্ব কাকে বলে, এই প্রশ্নটা আজকাল নতুন ভাবে ফিরে আসছে। কারণ একটাই। বীরত্ব কী, তার বিচিত্র, বৈভবময়, একমাত্রিক প্রদর্শনের নানা ব্যবস্থা ইদানীং চোখে পড়ে। সেই সমস্ত দৃশ্যে বীরত্ব বলতে পেশিবহুল মার-মার কাট-কাট ভাব ও ক্রিয়াকে বোঝায়। কাউকে প্রহারের মাধ্যমে বহিষ্কার করে দেওয়াই সেই বীরত্বের আকৃতি ও প্রকৃতি। সেই বীরের সর্বাঙ্গে স্বেদ-রক্ত। মাথা আকাশে তুলে বীরপুঙ্গব দণ্ডায়মান— শত্রুটি মৃত, বহিষ্কৃত। করতালির মাধ্যমে তৃপ্ত দর্শকেরা বলবেন, “বাহবা বাহবা বেশ!” শত্রুর শেষ রাখতে নেই। একটা গেলে তাই আর একটাকে শত্রু খুঁজে নিতে হয়। মানুষের বদলে কোনও দেশ, কোনও সংস্কৃতি পেশি ফুলিয়ে অন্য দেশ অন্য সংস্কৃতিকে নিকাশ করলেও একই ভাবে সেই দেশ বা সেই সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ বীরের দেশ বা সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় রসশাস্ত্রীরা অবশ্য এমন উত্তেজনাপরায়ণ পেশিবহুল হুঙ্কারকে বীরত্ব বলতে নারাজ। তাঁরা যুক্তিনিষ্ঠ ও মেধাবী। তাঁরা মনে করতেন ক্রোধ আর উৎসাহ দুই ভিন্ন ভাব। ক্রোধ থেকে রুদ্রমূর্তি জেগে ওঠে। ভীম দুঃশাসনের রক্তপান করছেন, এ রুদ্রমূর্তি। কৃষ্ণ ভয়ঙ্কর বাণ হাসি মুখে বক্ষে ধারণ করলেন, সে বাণ পুষ্পমালায় পরিণত হল— এ বীরমূর্তি। বীরত্বের মূলে রয়েছে উৎসাহ। সেই উৎসাহ কেবল অন্যকে ধ্বংস করার কাজেই লাগে না, গড়ে তোলার কাজেও লাগে। তাই তাঁরা দানবীর, দয়াবীর, কর্মবীর, ধর্মবীর এই রকম শব্দ ব্যবহার করতেন। দুঃখের হলেও সত্য যে, প্রাচীন ভারতের এই বিবেচনা আধুনিক ভারতের বীরপন্থীরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন।

Advertisement

বাঙালি বীর কি না, এই প্রশ্নও মাঝে-মাঝে উচ্চারিত হয়। বাঙালির বীরত্বের নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য তখন শত্রু নিকাশকারী আস্ফালনক্ষম মানুষের খোঁজ চলে। না পেলে সবাই ভাবে বাঙালি বীর নয়। অন্য ভারতীয়দের মতো বাঙালিও কিন্তু বীর। সে বীরত্ব নানা ক্ষেত্রে প্রকাশিত। বাঙালির বিদ্যাসাগর যুদ্ধ করেননি, তবু তিনি দানবীর। একই কথা মুহাম্মদ মহসিন সম্বন্ধে বলা যায়। বাঙালির বিবেকানন্দ লড়াই করেননি, কিন্তু পাশ্চাত্যে সর্ব-ধর্ম-সমন্বয়ের কথা প্রচার করেছেন বলে ধর্মবীর। একই ভাবে বাঙালি কবি নজরুলও বীর। কোথায় তাঁর বীরত্ব? তাঁর বীরত্ব কেবল যুদ্ধাঙ্গনে গিয়েছিলেন বলে প্রকাশিত হয়নি, তাঁর বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে। সেখানে যে বিরল সম্মিলনের উৎসাহ প্রকাশিত হয়েছে তাই তাঁর বীরত্বের প্রমাণ। নজরুল তাঁর সাহিত্যে পরিগ্রহণের উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন। বাংলা ভাষার মধ্যে তিনি সংস্কৃত উৎসজাত শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি উৎসজাত শব্দকে অনায়াসে গ্রহণ করেন। মরমিয়া ইসলামি ঐতিহ্যের পাশাপাশি অনায়াসে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন। গানের সুরে নানা ধারাকে মেলান। আবেগদীপ্ত পদ্যের পাশাপাশি সাংবাদিক গদ্যের তীক্ষ্ণতায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকদের বিদ্ধ করেন। উপনিবেশের প্রভুদের তিরস্কার করেন। এই নির্ভীকতায় ও সম্মিলনের উৎসাহে তিনি বীর। নিকাশ বা বহিষ্কার করার জন্য নয়, পরিগ্রহণের ও সম্মিলনের ধর্মেই তাঁর বীরত্ব। তাঁর এ-কাজ কিন্তু সহজ ছিল না। দারিদ্রের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠা, লোকায়ত ও মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য ধারণ করতে পারা দুখু মিয়া নজরুল হয়ে উঠছিলেন। এই বীরত্বের জন্য তিনি দুই বাংলার বাঙালির কাছে আদৃত। সাম্প্রদায়িক হিন্দু ও সাম্প্রদায়িক মুসলমানেরা তাঁকে দু’চোখে দেখতে পারে না।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই নজরুলের মতো এমন বীরেরা আছেন— সাহিত্য ক্ষেত্রে, সমাজে, ধর্মে তাঁরা পরিগ্রহণের উৎসাহে সমন্বয়ের বিপ্লবে বীর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের স্বাতন্ত্র্য কোথায় তা নির্দেশ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল অপরকে দখল করার ও বহিষ্কার করার পলিটিক্যাল মতলব এ দেশের ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয় না। যেখানে পার্থক্য আছে সেই পার্থক্যকে স্বীকার করে ঐক্যবিধান করতে হয়। পার্থক্য ও অসামঞ্জস্যকে খুঁচিয়ে প্রকট করে তোলা বীরত্ব নয়। নজরুলের বাংলা মুসলমানি বাংলা নয়, আবার তা হিন্দুর বাংলাও নয়। ভাষার বিস্তারে নানা উপাদানকে ব্যবহার করার মধ্যে বীরধর্ম প্রকাশিত। এই বীরত্বের মালা নজরুল অর্জন করেছিলেন। ভাষিক ও ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারাগার ভেঙে ফেলার মতো উৎসাহ যাঁর, সেই ভাষাবীরকে অস্বীকার করে তাঁর সৃষ্টিকে ভিন্ন সুরে গাইবার মধ্যে সৃষ্টির উন্মাদনা নেই, অনাচার আছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন