Joshimath

বিপর্যয়?

যে অঞ্চলে বহু পূর্বেই ভারী নির্মাণকাজ, গাছ কাটা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত থেকেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫১
Share:

বেশ কিছু কাল আগে থেকেই জোশীমঠের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরছিল, মাটি সরছিল ধীরগতিতে। ফাইল ছবি।

যা অপ্রত্যাশিত, আচমকা অভিঘাতে তছনছ করে দেয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল, তা নিঃসন্দেহে বিপর্যয়। কিন্তু জোশীমঠের বিপর্যয়কে তেমন তালিকাভুক্ত করা যায় কি? কোনও এক ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠা যে জনপদের সুরক্ষা নিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে বারংবার সতর্ক করা হয়েছে, এবং যথারীতি সমস্ত সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, ২০২৩ সালে এসে তার ভূগর্ভে তলিয়ে যাওয়া অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কি? আচমকাও নয়, কারণ বেশ কিছু কাল আগে থেকেই জোশীমঠের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরছিল, মাটি সরছিল ধীরগতিতে। সুতরাং, বিপদের আভাস ছিলই। যা ছিল না, তা হল সেই বিপদকে যথাযোগ্য গুরুত্ব প্রদানের সদিচ্ছা, নির্বাচনমুখী মানসিকতা থেকে সরে এসে প্রকৃত জনকল্যাণমুখী ভাবনা। বস্তুত, মানুষের লোভ এবং সরকারের অপরিণামদর্শী, বেপরোয়া উন্নয়নের তাড়না যুগপৎ কী ভাবে একটা আস্ত জনপদের মৃত্যু ডেকে আনে, জোশীমঠ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কী অনায়াসেই না ঘোষিত হল— জোশীমঠ আর বাসযোগ্য নেই। এবং ৬০০-র অধিক বাড়ি ও রাস্তায় ফাটল, প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জলধারাকে ঘিরে উদ্বেগ-মুহূর্তে জানা গেল, জোশীমঠকে বাঁচানোর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা বিষয়ে নাকি ভাবনাচিন্তা চলছে, পাহাড়ে পৌঁছচ্ছে বিশেষজ্ঞ দল। আশ্চর্য কুনাট্য!

Advertisement

জোশীমঠের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন মনে করা কঠিন। যে অঞ্চলে বহু পূর্বেই ভারী নির্মাণকাজ, গাছ কাটা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত থেকেছে। প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় প্রকল্পগুলিতেও বাধা পড়েনি। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য উন্নয়নের রথ ছুটছে অনেক কাল ধরেই, তবে গত আট বছরে প্রমাণিত, স্বপ্ন দেখানোয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জুড়ি মেলা ভার। এই মুহূর্তে উন্নয়নমুখী ঢাকের আওয়াজ এতই তীব্র যে, চাপা পড়ে গিয়েছে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের তীব্র আপত্তিও। এবং শুধু জোশীমঠই নয়, সমগ্র উত্তরাখণ্ডের পাহাড় জুড়েই অধিকাংশ নতুন সরকারি ভবন, অপরিকল্পিত বাজার, বহুতল, ঘিঞ্জি সড়ক গড়ে উঠেছে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। ন্যূনতম বিপর্যয় সুরক্ষাবিধিটুকুও মানা হয়নি। পর্যটন স্থলে গড়ে উঠেছে হেলিপ্যাড, যা হিমালয়ের মতো ভঙ্গুর, নরম মাটির পার্বত্য অঞ্চলের পক্ষে বিপজ্জনক। শুধুমাত্র এই রাজ্যটিতে সতেরোর অধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। পাহাড়ি নদীকে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে বেঁধে স্বাভাবিক জলধারাকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা যে পরিবেশের ভারসাম্যকেই নষ্ট করে দেয়, তা ইতিপূর্বে বহু আলোচিত। ভাগীরথীর উপর টিহরী বাঁধটি গড়ে উঠেছে যে অবস্থানে, তাতে এই বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুছে যেতে পারে হৃষীকেশ এবং হরিদ্বারও। অর্থাৎ, সুতোয় ঝুলছে রাজ্যের ভাগ্য।

এবং এই চিত্র শুধুমাত্র উত্তরাখণ্ডের নিজস্ব নয়। অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের চাপ কি পশ্চিমবঙ্গের মাথার উপরেও নেই? দার্জিলিং, কালিম্পং জেলাও ধস এবং ভূমিকম্পপ্রবণ। তা সত্ত্বেও সেখানে বেআইনি নির্মাণে লাগাম পড়েনি। যথেচ্ছ গাছ কেটে গড়ে উঠেছে বহুতল, রাস্তা। এই অঞ্চলের পাহাড় এখনও গড়ে উঠছে। নরম মাটিতে পাহাড়ের ঢালে বহুতল নির্মাণ করতে গেলে যে নিখুঁত পরিকল্পনা জরুরি, তা আদৌ হয়েছে কি? উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। কিন্তু প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে উন্নয়নই বিপর্যস্ত হবে। এ দিকে রাজনীতির ঔদ্ধত্যে এবং পর্যটনে লক্ষ্মীলাভের তাড়নায় পরিবেশ ঢের আগেই মুখ লুকিয়েছে। পরিবেশকে অবিলম্বে স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির বাইরে এক পৃথক সত্তা হিসাবে গণ্য করা প্রয়োজন। অন্যথায় কী হয়, তা প্রমাণ করে দিল জোশীমঠ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন