PM Narendra Modi

অতলান্তিক

দেশের বিপুল আর্থিক অসাম্যের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের ইস্তাহারে প্রস্তাব করা হয়েছে সম্পদের মালিকানা বিষয়ে বিশদ সমীক্ষার। সঙ্গত উদ্বেগ, জরুরি প্রস্তাব।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৫২
Share:

—ফাইল চিত্র।

ক ‌ংগ্রেস ক্ষমতা হাতে পেলে হিন্দুর সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মুসলমানের হাতে তুলে দেবে— নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী ভাষণে নিহিত এমন বার্তায় যুগপৎ পরশুরাম এবং সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ে। ‘মহাপুরুষ’ বিরিঞ্চিবাবার বাগ্‌বিভূতির ব্যাখ্যানে বিস্মিত নিতাইদা প্রশ্ন করেন: “এ কথা সে বললে? অতগুলি লোকের সামনে? সে কথা সবাই বিশ্বাস করলে?” ননীর সংক্ষিপ্ত জবাব: “সবাই ক্ল্যাপ দিলে। তুইও দিতিস।” রাজস্থানের জনসভাতেও নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয়ই বিস্তর ক্ল্যাপ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি বিরিঞ্চিবাবা নন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাহিনিটি কৌতুকের নয়, বিভীষিকার। রাজনৈতিক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে বিভীষিকা বর্তমান শাসকদের বহুব্যবহৃত হাতিয়ার, রাজস্থানে— সম্ভবত ভোটের বাজারে বেগতিক দেখে— সেই গরলস্রোতই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। দেশের প্রধানমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে ঘোষণা করলেন: প্রতিপক্ষ কংগ্রেস হাতে ক্ষমতা পেলে ‘আপনাদের’ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদের হাতে তুলে দেবে, যারা অনুপ্রবেশকারী, যাদের ঘরে ঘরে ছেলেমেয়ে বেশি... ‘আপনাদের’ মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও বেহাত হয়ে যাবে। অতলান্ত বিদ্বেষের কৃষ্ণগহ্বরে আবার বেবাক হারিয়ে গেল সভ্যতার ন্যূনতম বিধানটুকুও।

Advertisement

দেশের বিপুল আর্থিক অসাম্যের প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের ইস্তাহারে প্রস্তাব করা হয়েছে সম্পদের মালিকানা বিষয়ে বিশদ সমীক্ষার। সঙ্গত উদ্বেগ, জরুরি প্রস্তাব। অসাম্য দুনিয়া জুড়েই এক বিরাট সমস্যা বলে চিহ্নিত, ভারতেও। এই সমস্যার মোকাবিলায় সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টনের কথা সাম্প্রতিক কালে দুনিয়ার বহু বিশেষজ্ঞই আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর বাণিজ্য-বন্ধুরা সেই প্রস্তাবে কুপিত হতে পারেন, যে কোনও রকমের পুনর্বণ্টনের বিরোধিতা করতে পারেন, সেই অধিকার অবশ্যই তাঁদের আছে। কিন্তু তার সূত্র ধরে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা একই সঙ্গে লজ্জাকর এবং ভয়ঙ্কর। এই চেষ্টার সূত্রে প্রধানমন্ত্রী খুঁড়ে এনেছেন পূর্বসূরি মনমোহন সিংহের একটি উক্তি: দেশের সম্পদের উপর সংখ্যালঘুদেরই প্রথম অধিকার। বলা বাহুল্য, কথাটি এক নৈতিক আদর্শের সূচক, যে আদর্শ অনুসারে গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু— সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘু— মানুষের সুরক্ষা এবং সুযোগ বিধান করা সংখ্যাগুরুর এক পরম দায়িত্ব। এই আদর্শ অন্য এক সভ্যতার গল্প বলে, এ দেশের সংবিধানে যার প্রগাঢ় স্বীকৃতি আছে। সেই সভ্যতা থেকে বর্তমান ভারতশাসকরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাঁরা সংখ্যালঘুকে পায়ের নীচে সদাসন্ত্রস্ত করে রাখতে চান, এবং সেই লক্ষ্য যখন মোটের উপর পূর্ণ হয়ে এসেছে, তখন সংখ্যালঘুর জুজু দেখিয়ে ক্রমাগত সংখ্যাগুরু ভোট এক জায়গায় আনতে চান। সেই অভিযানের মহানায়কের আচরণে বিস্ময়ের কিছু নেই।

কিন্তু তীব্র আপত্তির কারণ আছে। এবং প্রয়োজন আছে এই বিদ্বেষ-ভাষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা করার। দেশের আইনে, বিশেষত নির্বাচনী আচরণ-বিধিতে তার যথেষ্ট হাতিয়ার মজুত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক ভাষণ নিঃসন্দেহে আচরণ-বিধির মৌলিক শর্তগুলিকে কেবল লঙ্ঘন নয়, চুরমার করে দিয়েছে। এই অন্যায়ের প্রতিবিধানের অধিকার ও দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির, তার নাম নির্বাচন কমিশন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে রাজনৈতিক ও সামাজিক সুস্থিতি ও সম্প্রীতির পক্ষে হানিকর এবং সরাসরি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে বিষাক্ত উক্তি শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে শাসনদণ্ড কার্যকর করাই ছিল কমিশনের কাজ। কিন্তু বহু দিক থেকে অজস্র অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেও তারা প্রথমে বলেছে: ‘আমরা মন্তব্য করতে অস্বীকার করি’ এবং তার পরে, দৃশ্যত মুখরক্ষার খাতিরে, আশ্বাস দিয়েছে: দেখছি। মুখ নয়, কমিশনের একটি অঙ্গেরও মর্যাদা বলতে আর কিছু বাকি নেই। অমৃত কাল-এ বোধ করি এমনটাই স্বাভাবিক।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন