India

জগৎসভায়

সম্প্রতি বিশ্বের দরবারে ভারত এক বিশেষ সম্মান পেয়েছে। এক বছরের জন্য জি-২০ নামক দেশগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেবে এই দেশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২২ ০৪:৩৫
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।

আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে নীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সম্পর্কে লিখেছিলেন, তিনি “পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলির কাছে ভারতের প্রতিনিধি, এবং ভারতের কাছে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতিনিধি।” এমন একটি কথার আধারে নিহিত থাকে এক সমৃদ্ধ কালের ইতিবৃত্ত। দেশভাগের মধ্য দিয়ে জন্ম-নেওয়া স্বাধীন ভারত সে-দিন মহাযুদ্ধ-উত্তর বিশ্বের পরিসরে নিজস্ব অবস্থান খুঁজে নিতে চেয়েছিল উদার গণতন্ত্রের কঠিন ও সঙ্কটময় সাধনার মূল্যে। দরিদ্র দেশের পক্ষে একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক নিষ্পক্ষতা বজায় রেখে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া কতখানি কঠিন ছিল, আজ তা উপলব্ধি করা সহজ নয়। বহু অপ্রাপ্তি, অনেক ঘাটতি এবং বিস্তর ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ভারত সেই সাধনা জারি রাখতে ব্যর্থ হয়নি। দুই মেরুতে বিভক্ত বিশ্বে নিজস্ব অবস্থানে সুস্থিত থেকে গণতন্ত্রের অনুশীলনে তার সাফল্য জগৎসভার সসম্ভ্রম স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। নেহরুর ব্যক্তিত্ব, তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দেশের ভিতরে সুপ্রসারিত গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি বৃহত্তর দুনিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মর্যাদা, এই সবই ছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারতের বড় সম্পদ। কিন্তু সেই অর্জন কেবল ব্যক্তিগত হতে পারে না, তা ছিল একটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অর্জিত সম্মান। উদার, বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক সেই সংস্কৃতিই সে-দিন ভারতকে তার সমস্ত দারিদ্র, পশ্চাৎপদতা এবং সমস্যা সত্ত্বেও বিশ্বের দরবারে মর্যাদা দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং তাঁর নেতৃত্ব ছিল সেই সংস্কৃতির এক প্রতিভূ।

Advertisement

সম্প্রতি বিশ্বের দরবারে ভারত এক বিশেষ সম্মান পেয়েছে। এক বছরের জন্য জি-২০ নামক দেশগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেবে এই দেশ। ইন্দোনেশিয়ায় জি-২০’র বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন শেষে রীতি মাফিক নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর ঘটেছে, সভাপতি পদের অভিজ্ঞান-হাতুড়িটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর করধৃত হয়েছে, সেই মহালগ্নে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল গর্বিত আননের ছবি ইতিমধ্যে বহুলপ্রচারিত। নিন্দকে বলতেই পারে— কুড়িটি (আপাতত পুতিন-ঘটিত কারণে উনিশটি) দেশের কেউ না কেউ এক-এক বছর গোষ্ঠীর নেতা হবে, এ-বছর ভারতের পালা, এ নিয়ে অহঙ্কারের কী আছে, বিগলিত হওয়ারই বা কী আছে? কিন্তু নিন্দকের কথায় কান দিতে নেই। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই মনে রেখেছেন, আগামী শরতে ভারতে এই শীর্ষ বৈঠকের অনুষ্ঠান হবে, দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়করা আসবেন, দিল্লি হবে বিশ্বের মহামঞ্চ, তার আলোয় দিল্লীশ্বররা উদ্ভাসিত হবেন। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের ভাবমূর্তি সেই আলোয় আলোকময় হয়ে উঠবে। অনুমান করাই যায়, আগামী এক বছর ধরে ভারতের নাগরিক নানা ভাবে ক্রমাগত শুনবেন মহতী অমৃতবাণী: ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছে। সেই বাণী শুনে ভক্তজন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলবেন: সেই সত্য, যা রচিলে তুমি।

জি-২০ উপলক্ষমাত্র। বৃহত্তর প্রশ্নটি হল, আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের গুরুত্ব কী ছিল এবং কী দাঁড়িয়েছে। আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিই গুরুত্বের প্রধান নির্ণায়ক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা তুচ্ছ করলে কেবল ভুল হয় না, অন্যায় হয়। সাম্প্রতিক কালে আমেরিকা, চিন এবং অধুনা রাশিয়ার টানাপড়েনের কারণে ভারতীয় কূটনীতিকে যে কঠিন পরীক্ষা দিয়ে চলতে হচ্ছে, তার মাপকাঠিতে বিচার করলে সাউথ ব্লকের কৃতিত্ব নিশ্চয়ই বেশ কিছুটা স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু গুরুত্ব আর মর্যাদা এক নয়। স্বাধীনতার পরে অনেক দিন অবধি ভারত বিশ্বসভায় তার অর্থনৈতিক-সামরিক গুরুত্বের তুলনায় অনেক বেশি মর্যাদা পেয়েছে তার উদার গণতান্ত্রিক আদর্শের কল্যাণে। সেখানেই আজ তার ভান্ডার দীন থেকে দীনতর হতে হতে ক্রমে শূন্যপ্রায়। মর্যাদা দূরস্থান, নানা কারণে তার অসম্মানের বোঝাই বেড়ে চলেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মানবাধিকারের সুরক্ষা, গণতন্ত্রের বিভিন্ন আবশ্যিক সূচকে দুনিয়ার হাটে ভারতের স্থান ক্রমশই অধোগামী। প্রধানমন্ত্রী যখন জি-২০’র হাতুড়ি হাতে নিয়ে আহ্লাদিত, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনের কর্তারা মানবাধিকারের প্রশ্নে সৌদি আরবের শাসকদের ‘ছাড়’ দেওয়ার ‘যুক্তি’ হিসাবে তাঁর নাম উল্লেখ করছেন। বিদেশ মন্ত্রক এমন সমীকরণের প্রতিবাদে সরব হলেই কলঙ্ক মুছে যাবে কি? নেহরুর স্পষ্ট উত্তর হত: না। প্রধানমন্ত্রী মোদী হয়তো প্রশ্নটিকেই গ্রাহ্য করবেন না। ভারত অনেক দূরে চলে এসেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন