Make in India Scheme

ভ্রান্তি

ভোগনির্ভর অর্থনীতির মহামধ্যাহ্নে যদি কেউ বলেন যে, শিল্পোৎপাদনের গুরুত্ব ফুরিয়েছে, সেই কথায় ভ্রুকুঞ্চন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৩ ০৪:২৫
Share:

জিডিপি-র অনুপাতে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রের আয়তন বাড়েনি তো বটেই, বরং সামান্য কমেছে। প্রতীকী ছবি।

২০১৫ সালে যখন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটির সূচনা হয়েছিল, তার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল এই যে, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র অনুপাতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রের আয়তন বৃদ্ধি করতে হবে। আরও অনেক উচ্চাভিলাষের মতো এই শপথটিও যমুনার কালো জলে ভেসে গিয়েছে। শেষ হিসাব দেখাচ্ছে যে, জিডিপি-র অনুপাতে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রের আয়তন বাড়েনি তো বটেই, বরং সামান্য কমেছে। কেন, সে বিষয়ে স্বভাবতই সাতকাহন সম্ভব। সরকার পক্ষ সে আলোচনায় অতিমারির প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে। জানাবে যে, কী ভাবে গোটা দুনিয়াতেই অতিমারির ফলে, এবং তার পরবর্তী কালে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রটি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রসঙ্গ উঠবে অর্থনীতির আকাশে মন্দার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ঘনিয়ে আসা, এবং রফতানি শ্লথ হওয়ারও। উল্টো দিকে, বিরোধী পক্ষ দাবি করবে যে, অতিমারির আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ ঘটেছিল। যে-হেতু ভারতের উৎপাদন এখনও মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদানির্ভর, ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমায় শিল্পোৎপাদনও স্বভাবতই কমেছে। এই তর্কটি ভারতবাসীর বিলক্ষণ চেনা। সম্প্রতি ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ লর্ড মেঘনাদ দেশাই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র সাফল্যগাথাটিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। সেই নস্যাৎ-ভঙ্গির ক’আনা প্রকৃতার্থে গ্রাহ্য, সেই তর্ক চলতে পারে। কিন্তু, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে একটি অন্য কথাও নিহিত ছিল, যা সম্ভবত তুলনায় মূল্যবান এবং বিবেচনাযোগ্য। লর্ড দেশাই বলেছেন, দুনিয়া পাল্টে গিয়েছে— এখন আর বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন কেন্দ্র হয়ে ওঠার খোয়াবকে আশ্রয় করে অর্থনৈতিক মহাশক্তি হয়ে ওঠা যাবে না। দুনিয়া এখন পরিষেবার দিকে ঝুঁকছে, ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কথা ভাবতে হলে ভারতকেও সেই পথেই হাঁটতে হবে।

Advertisement

ভোগনির্ভর অর্থনীতির মহামধ্যাহ্নে যদি কেউ বলেন যে, শিল্পোৎপাদনের গুরুত্ব ফুরিয়েছে, সেই কথায় ভ্রুকুঞ্চন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। লর্ড দেশাইয়ের মন্তব্যটি কিঞ্চিৎ লবণ সহযোগে গ্রহণ করাই বিধেয়। কিন্তু, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কথাটির একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। ভারতে আর্থিক সংস্কার ও বিশ্বায়নের পর তিন দশকাধিক কাল অতিক্রান্ত। এই সময়কালে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার যে চলন, তাতে পণ্য উৎপাদনের মহাশক্তি হিসাবে কিছু দেশ চিহ্নিত হয়েছে, কিছু দেশ স্বীকৃতি পেয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রে। ভারত প্রশ্নাতীত ভাবে দ্বিতীয় গোষ্ঠীভুক্ত। বলা যেতে পারে, বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের তুলনামূলক শক্তি পরিষেবা ক্ষেত্রেই রয়েছে। এবং, এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির মঞ্চে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটছে। কৃত্রিম মেধা এবং রোবটিক্স পাল্টে দিচ্ছে অর্থব্যবস্থার খোলনলচে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্বমঞ্চে ভারতের যে অবস্থান, মূল্যশৃঙ্খলে তা অপেক্ষাকৃত নীচের দিকে রয়েছে। ফলে, এই অবস্থায় ভারত যদি ভবিষ্যৎমুখী পরিষেবা ক্ষেত্রের দিকে মন দেয়, তা হলে সম্ভবত মূল্যশৃঙ্খলেও উন্নতি সম্ভব, দ্রুততর গতিতে আর্থিক বৃদ্ধিও সম্ভব।

কথাটি বোঝা খুব কঠিন নয়। কিন্তু, তাকে রাজনৈতিক ভাবে স্বীকার করা অসুবিধাজনক। শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি নিবিড় ভাবে জড়িত। ফলে, সে ক্ষেত্রে যদি আদৌ উন্নতি সম্ভব না হয়, যদি বিশ্বমঞ্চে প্রতিযোগিতার যোগ্যতা ভারত অর্জন না করতে পারে, তবুও তার একটি রাজনৈতিক ‘অপটিক্স’ রয়েছে। পরিষেবা ক্ষেত্রেও কর্মসংস্থান সম্ভব— বস্তুত, শিল্পের চেয়ে বেশিই সম্ভব— কিন্তু তার জন্য শ্রমশক্তির উন্নয়নে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। শ্রমশক্তিকে শিক্ষিত, দক্ষ করে তুলতে হবে। তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নীতিগত অভিমুখের পরিবর্তন। এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় ‘আত্মনির্ভরতা’-র স্লোগান যে নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য, সে কথাটি স্বীকার করতে হবে। এবং, আত্মনির্ভরতার মোড়কে সাঙাততন্ত্রের প্রতিপালনের প্রবণতাটিও ত্যাগ করতে হবে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পরিচালকেরা তার জন্য আদৌ প্রস্তুত কি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন