Visva-Bharati University

গৌরবের অপমান

রাজনীতির কারবারিদের অহমিকার বেসাতি এখন চেনা দৃশ্য, মনীষীদের জন্মদিনে তাঁদের বাণীর পাশে আর তাঁদের ছবি থাকে না, থাকে নেতা-মন্ত্রীর মুখচ্ছবি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪২
Share:

বিশ্বভারতীর এই ফলক নিয়েই বিতর্ক। —ফাইল চিত্র।

পূজার ছলে আরাধ্যকেই ভুলে থাকার আক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাঁর গানে। প্রকৃতির অসম্ভবকে সম্ভব করে এখনও জীবিত থাকলে তিনি দেখে যেতে পারতেন,
তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী-র বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিস্মৃত হয়েছেন, বিনা ছলেই। ছল নেই, তবে বল ও কৌশলটি সেখানে বিলক্ষণ বিরাজমান। ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থল’ বলে কথা, তার পাথুরে প্রমাণটি না রাখলে চলবে কেন। তাই অচিরেই শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকরা দেখলেন, উপাসনা মন্দির, ছাতিমতলা এবং রবীন্দ্র ভবনের সামনেও বসে গেল প্রস্তরফলক, এবং কিমাশ্চর্যম্‌— কাজের তথ্যটুকু ছাড়া সেখানে জ্বলজ্বল করছে কেবল দু’টি নাম: বিশ্বভারতীর আচার্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর, এবং উপাচার্যের! ঠিক যে কারণে এবং যাঁর কারণে শান্তিনিকেতন ইউনেস্কোর এই সম্মান পেল, সেই ‘বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক’ রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ নেই, ‘বিশ শতকের গোড়ায় প্রচলিত ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতি ও ইউরোপীয় আধুনিকতা’র দর্শন থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র এক পরিসর হিসাবে শান্তিনিকেতনের যে বিশিষ্টতা ইউনেস্কোর নজর কেড়েছে, নেই তার নামগন্ধটুকুও।

Advertisement

এখন শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক থেকে বিশ্বভারতীর ছাত্র ও শিক্ষকমহল অসন্তোষ গোপন করেননি, রাজনৈতিক বিরোধীরাও যখন প্রতিবাদ করেছেন, তখন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফে আসছে ‘সংশোধনী’, এই ফলক নিতান্তই সাময়িক, ইউনেস্কোর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে চটজলদি-গড়া— পরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও ইউনেস্কোর কাছ থেকে মূল লেখাটি এলে ভাল করে ফলক তৈরি হবে, তাতে সব কিছুই লেখা থাকবে। গলা না চড়ালে, প্রতিবাদ না করলে এই বিবৃতিও আসত কি না সন্দেহ, কেননা বিশ্বভারতীর উপাচার্যের আচার-আচরণ ও চলনবলন এত দিনে শুধু শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতীর সকলের নয়, বঙ্গবাসীরও বিলক্ষণ জানা হয়ে গিয়েছে। সেই হাবভাব আর যা-ই হোক, রবীন্দ্র-অনুসারী নয়। দিল্লিবাসী আচার্য না হোক, উপাচার্য তো নিশ্চয়ই সেই গানটি জানেন, তাঁর পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিশ্চয়ই শতলক্ষ বার এই চরণটি গীতও হয়েছে: ‘আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে’। ফলকে রবীন্দ্রনামটি না রাখলেও যে তাঁর গুরুত্বের বিন্দুমাত্র হানি হয় না তা রবীন্দ্রপ্রেমী বাঙালিমাত্রেই জানেন। কিন্তু ফলকে আচার্য-উপাচার্যের নাম দু’টি সযত্নে খোদাই করে রাখার মধ্যে যে প্রবণতাটি ফুটে বেরোল, সে-ও লেখা আছে ওই গানেই: ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান’। উপাচার্য কি তা আদৌ বুঝলেন?

রাজনীতির কারবারিদের অহমিকার বেসাতি এখন চেনা দৃশ্য, মনীষীদের জন্মদিনে তাঁদের বাণীর পাশে আর তাঁদের ছবি থাকে না, থাকে নেতা-মন্ত্রীর মুখচ্ছবি। দুর্ভাগ্য, সেই একই প্রবণতা এখন শান্তিনিকেতনেও, এবং তা করে দেখালেন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের ‘বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ’-এর অভিভাবক, বর্তমান উপাচার্য। ফলক বসিয়েই কাজ শেষ হয়নি, তার ‘রক্ষা’য় নিযুক্ত হয়েছেন দু’জন রক্ষীও। অর্থাৎ ভয়ও আছে, স্বসৃষ্ট গৌরববেদি থেকে উন্মূল হওয়ার ভয়। সত্যভাষণে যেমন কী বললাম তা মনে রাখার বিষম বোঝাটি থাকে না, সৎ কাজে তেমনই দ্বারপালের প্রয়োজন পড়ে না, সমষ্টির জোরই তার রক্ষক হয়ে ওঠে। ফলকে যা লেখা আছে তা তো দৃশ্যমানই, যা অগোচর তা থেকেও উপাচার্য শিক্ষা নিলে ভাল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন