CPIM

চেতনার নিম্নমান

কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া জেলায় জেলায় দলীয় নেতা ও কর্মীদের মতামত জানিবার পরে রাজ্য কমিটি চব্বিশ পাতার রিপোর্ট তৈয়ারি করিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২১ ০৬:৩০
Share:

প্রতীকী ছবি।

সমাজমাধ্যমে সম্প্রচারিত রঙ্গরসিকতার নিরন্তর স্রোতে বিস্তর আবর্জনা ভাসিয়া চলে বটে, কিন্তু ছাঁকিয়া তুলিতে পারিলে কিছু কিছু মণিমুক্তাও মিলিতে পারে বইকি। যেমন, সম্প্রতি দেখা গেল একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, যাহার মর্মার্থ: পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম অনেক কাঠখড় পুড়াইয়া আবিষ্কার করিয়াছে, সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়। দলীয় সম্মেলনে রাজ্য কমিটি যে খসড়া রিপোর্ট দাখিল করিয়াছে, তাহার একটি বক্তব্যকে নিশানা করিয়াই এই তির্যক উক্তি। সেই বক্তব্যের প্রতিপাদ্য: বিধানসভা নির্বাচনে দলীয় প্রচারে বিজেপির বিরোধিতা যথেষ্ট জোরদার ছিল না; তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করিয়া দল কোনও ভুল করে নাই, কিন্তু সেই বিরোধিতার তোড়ে বিজেপি-বিরোধিতা ভাসিয়া গিয়াছে; এবং ইহা ভোটের লড়াইয়ে দলের ক্ষতি করিয়াছে। নির্বাচনের ফল হাতে পাইবার পরে কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া জেলায় জেলায় দলীয় নেতা ও কর্মীদের মতামত জানিবার পরে রাজ্য কমিটি চব্বিশ পাতার রিপোর্ট তৈয়ারি করিয়াছে। বেশ করিয়াছে। ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র অনুশীলন ভাল কাজ। জনাদেশের তাৎপর্য বুঝিতে এই তৎপরতাও গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ। প্রশ্ন একটিই। এত গবেষণা করিয়া অতিপ্রাজ্ঞ দলনেতারা নির্বাচনী প্রচারের যে ত্রুটি আবিষ্কার করিলেন, গোটা ভোটপর্বে যখন বিভিন্ন মহল হইতে সেই ত্রুটির কথাই বারংবার বলা হইতেছিল, তখন তাঁহারা সেই কথায় কর্ণপাত করেন নাই কেন? বস্তুত, কথা শোনা দূরস্থান, সিপিআইএমের বিবিধ স্তরের প্রচারক ও কর্মীরা বিজেপির প্রতি ‘নরম’ হইবার অভিযোগ শুনিলেই তীব্র উষ্মা প্রকাশ করিয়া আসিয়াছেন, নেতা এবং প্রার্থীরা যত বলিয়াছেন, পারিষদ-দলে বলিয়াছেন তাহার শতগুণ। অথচ আজ রাজ্য কমিটির রিপোর্ট কার্যত সমালোচকদের অভিযোগেই সিলমোহর লাগাইয়া দিল। সিপিআইএমের অগ্নিবর্ষী চিৎকারকরা কি অতঃপর এই রিপোর্টের রচয়িতাদের ‘বিজেমূল’ বলিবেন?

Advertisement

ইতিহাসে যাঁহারা কখনও নিজেদের কোনও ভুল খঁুজিয়া পান না, কেবল ‘জনগণ ভুল বুঝিয়াছেন’ মন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন, তাঁঁহারা তবে এ বার ‘ভুল’ খুঁজিয়া পাইলেন। কেন এই ভুল, তাহার ব্যাখ্যা করিতে গিয়া রিপোর্টে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলা হইয়াছে: দলের ঝুলিতে দুই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিস্তর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এ বার সেই লড়াইয়ের সম্মুখীন হইয়া সমস্ত বিরোধিতা একটি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে— তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে— কেন্দ্রীভূত করিবার এবং অন্য প্রতিপক্ষকে— বিজেপিকে— লঘু করিয়া দেখিবার যে প্রবণতা, তাহার জন্য দায়ী দলের মধ্যে ‘চেতনার নিম্নমান’। এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির চেতনাকে উন্নত করিবার যুগান্তকারী দায়িত্ব যে সর্বশক্তিমান ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’র করকমলে ন্যস্ত, তাহার চেতনার নিম্নমান? চেতনার নায়করা তবে কী করিতেছিলেন? সন্দেহ হয়, নীচের তলার ভ্রান্তির সমালোচনা করিয়া দলের উপরমহলের কর্তারা আপন দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলিতে চাহিতেছেন না তো? দলের সাধারণ সম্পাদক যে কঠিন ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারকৌশলের সমালোচনা করিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ গাঢ়তর হয়। উগ্র ও বিকৃত অতিজাতীয়তাবাদ, সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র-বিরোধী আধিপত্যবাদের ধারক বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার নামক বিপদটি কেন অন্যান্য রাজনৈতিক বিপদ হইতে স্বতন্ত্র, এই মৌলিক সত্য দলের সর্বস্তরে রাজনৈতিক চেতনার বাহিরে থাকিয়া গেল, গোটা ভোটপর্বে দলীয় কর্মীরা সঙ্কীর্ণ তরজায় মাতিয়া থাকিলেন, আর মহামান্য নেতারা আজ দলের মধ্যে চেতনার নিম্নমান খুঁজিয়া পাইতেছেন? সত্য ইহাই যে, উপর হইতে নীচ অবধি দলের চেতনার সংস্কার জরুরি। সুকঠিন সত্যকে স্বীকারের সততা কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকিলে নেতারা অবিলম্বে সেই কাজে হাত দিন। কাজটি শুরু হউক আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন