প্রতীকী চিত্র।
কোভিডের কালে দুনিয়ায় বই পড়িবার মাত্রা কি বাড়িয়াছে? পাঠ্যপুস্তকের কথা হইতেছে না, কিন্তু বই পড়িবার জন্যই বই পড়া? সমাজের যে বর্গের মানুষের তেমন পাঠের অভ্যাস আছে, গত দেড় বৎসর কাল তাঁহাদের অনেকের হাতেই সময় বেশি, বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইবার পথ বন্ধ অথবা সঙ্কুচিত, আড্ডা দিবার সুযোগও অন্তর্হিত কিংবা নিয়ন্ত্রিত— অনেকেই হাতে তুলিয়া লইয়াছেন এমন বিবিধ বইপত্র, যাহা এত কাল সময়-সুযোগের অভাবে ‘পড়িব পড়িব’ ভাবিয়া তুলিয়া রাখিয়াছিলেন। পারস্পরিক কথোপকথনে এবং সমাজমাধ্যমের পরিসরে এমন অভিজ্ঞতার কথা অনেকেই জানাইয়াছেন। সংক্রমণের আদিপর্বে জীবনযাপনের আকস্মিক রূপান্তরের অভিঘাতে অতি বড় পাঠকও অবশ্যই বেসামাল হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহার পরে, ‘নিউ নর্মাল’-এ অভ্যস্ত হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই নিজ নিজ পাঠে মন দিয়াছেন। উৎসাহীরা সমাজমাধ্যম মারফত আপন পাঠের খবরাখবর অন্যদের জানাইয়াছেন, অনেকেই তাহাতে ক্ষান্ত না হইয়া কী কী বই পড়িলেন তাহার সচিত্র প্রমাণও দাখিল করিয়াছেন। বই কিনিবার এবং পড়িবার মধ্যে দূরত্ব অবশ্য চিরকালীন এবং সর্বজনীন একটি সত্য, অতএব ‘অদ্য এই বইগুলি হাতে পাইলাম’ নামাঙ্কিত গ্রন্থস্তূপের চিত্রগুলি দেখিয়া সংশয় জাগিতেই পারে— ইহাদের কতগুলি পঠিত হইবে এবং কতগুলি গৃহশোভা হইয়াই বিরাজ করিবে? কিন্তু গ্রন্থপ্রেমীরা বলিবেন, তাহাতে কিছু যায় আসে না, পড়িবার বাসনাই গ্রন্থপ্রেমের প্রথম এবং প্রধান ধর্ম। বাস্তবিকই, কি প্রেমে, কি পাঠে— অতৃপ্ত বাসনাকে তুচ্ছ করে, কাহার সাধ্য? অতিমারির কালে গ্রন্থপাঠ কতটা বাড়িল, তাহার হিসাব ভবিষ্যতে পাওয়া যাইবে, তেমন হিসাব কষিবার তাগিদে দুনিয়া জুড়িয়াই নানা সমীক্ষা চলিতেছে। কিন্তু ষোলো আনা হউক, আট আনা হউক, গৃহবন্দি জীবন যদি বহু লোকের মনে বই পড়িবার বাসনায় ইন্ধন জুগাইয়া থাকে, তাহার মূল্য অনেক।
কেন? গ্রন্থপাঠ কি কেবল এই কারণেই মূল্যবান যে, তাহা পাঠকের জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা বাড়াইয়া তুলিতে পারে? জ্ঞানান্বেষণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিদ্যাচর্চার ভুবনে তো বটেই, দৈনন্দিন জীবনেও। বিশেষত, অসত্য এবং অর্ধসত্যের দিগ্বিজয়ী অভিযান যখন তুঙ্গে, সেই অন্ধকার সময়ে যথার্থ তথ্য ও জ্ঞানের চর্চা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই জীবনমরণের প্রশ্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, যত লোকের মধ্যে সেই চর্চার প্রসার ঘটে ততই মঙ্গল। গ্রন্থপাঠই তাহার একমাত্র উপায় নহে, কিন্তু আজও, এই তথ্য-বিস্ফোরণের কালেও, তাহা অন্যতম প্রধান উপায়। বস্তুত, প্রচার-প্রযুক্তির অকল্পনীয় বিস্ফোরণের কারণেই, সত্যাসত্যবিনিশ্চয়ের কাজটি অনেক বেশি কঠিন হইয়াছে, ফলে গ্রন্থের মূল্য বিশেষ ভাবে বাড়িয়াছে। বই পড়িয়াও নিশ্চয়ই ভুল শিখিবার আশঙ্কা থাকে, মিথ্যাকে সত্য বলিয়া জানিবার সম্ভাবনা থাকে, বিশেষত বিদ্বেষ এবং হিংস্রতার প্রচারে বইপত্রের কলঙ্কিত ভূমিকার ইতিহাস সত্যই ভয়াবহ, এবং তাহার বিষ তেজস্ক্রিয় পদার্থের মতোই দুর্মর— হিটলারের আত্মজীবনীর কাটতি এখনও বিপুল। কিন্তু শতপুষ্পের সহিত আগাছাও থাকিবে, তাহার মধ্যে কিছু বিষাক্তও হইবে; কিন্তু, পড়িবার এবং জানিবার ভুবনটি যদি মুক্ত থাকে তবে মানুষ গরল হইতে অমৃতকে আলাদা করিতে পারিবে, মানুষের উপর অন্তত এই বিশ্বাসটুকু হারানো চলে না। অতএব, বিপন্ন মানবসভ্যতা প্রার্থনা করিবে: শতগ্রন্থ বিকশিত হউক।
কিন্তু, কেবল তথ্যসন্ধান নহে, কেবল জ্ঞানান্বেষণ নহে, বই পড়িবার আরও এক উপযোগিতা আছে, তাহাই হয়তো গভীরতম উপযোগিতা। তাহা আপন হইতে বাহির হইয়া বাহিরে দাঁড়াইবার সুযোগ দেয়, অপরকে জানিবার, অপরের মস্তিষ্ককে জানিবার, অপরের হৃদয়কে বোধ করিবার অবকাশ দেয়। কেবল ভিন্নমত বা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি নহে, বিভিন্ন মানসিকতার এই বোধই ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে বৃহৎ মানুষে পরিণত করিতে পারে। এই কারণেই সুসাহিত্যের পাঠ চিরকালই শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বলিয়া গণ্য হইয়াছে। এ-কালের বাজার-নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার আয়োজনে সেই গুরুত্ব অস্বীকার করিবার প্রবণতা যত বাড়িতেছে, শিক্ষাবিদরা সঙ্গত কারণেই তত উদ্বিগ্ন হইতেছেন। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ অন্যত্র। এই পরিসরে এইটুকুই বলিবার যে, অতিমারির ‘কল্যাণে’ বই পড়িবার কিছু বাড়তি সময় ও সুযোগ যদি মিলিয়াই থাকে, তবে তাহার সদ্ব্যবহার করিলে পাঠকের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হইতে পারে। প্রতিষেধক হিসাবেও সদ্গ্রন্থের জুড়ি নাই।
যৎকিঞ্চিৎ
সংবাদ সিনেমা মাত্র! সম্প্রতি বাঁকুড়া স্টেশনে ধরা পড়লেন এক ছদ্মভিখারি। মহাশয় মাসিক ষাট হাজার টাকা বেতনের সরকারি কর্মী। ব্যাঙ্কে ৮০ লক্ষ টাকার আমানত, তবু এক্সট্রা টু পাইস রোজগারের জন্য ভিক্ষা করাই তাঁর নেশা। মধুর ভান্ডারকরের ট্র্যাফিক সিগনাল ছবিতে এই রকমই ছিল— এক অফিসবাবু মাঝপথে পোশাক পাল্টে ছেঁড়া ন্যাতাকানি পরে নিতেন, তার পর রাস্তায় ভিক্ষা করতেন। বাংলায় ভুয়ো ভ্যাকসিন, ভুয়ো আমলার পরে এ বার সিনেমাটিক ভুয়ো ভিখারি!