BJP

সবার উপরে

আত্মশ্লাঘা এখন রাজনীতির নায়কনায়িকাদের পরম ধর্ম। প্রজারা সম্বৎসর এবং অষ্টপ্রহর তাঁদের অতিকায় চিত্রপ্রদর্শনী এবং উচ্চরব বন্দনাগীতি দেখে-শুনে চমৎকৃত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৪০
Share:

অনেক কাল আগের কথা। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল সাফল্যের পরে দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ‘রাষ্ট্রপতি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তার লেখক ‘চাণক্য’ দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহরুর প্রতি অতিভক্তির বশে দেশবাসী যেন তাঁকে মাথায় না তোলেন, কারণ— “তাঁর আত্মশ্লাঘা এমনিতেই প্রবল। তা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আমরা কোনও সিজ়ারকে চাই না।” ছদ্মনামের আড়ালে এই নিবন্ধ লিখেছিলেন নেহরু নিজে! ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় কর্মসমিতির সাম্প্রতিক বৈঠকের বিবরণ জেনে ইতিহাস-সচেতন নাগরিকের প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন সেই লেখাটির কথা মনে পড়তে পারে। ওই সম্মেলনে শাসক দলের নেতারা সমবেত ভাবে নরেন্দ্র মোদীর মহিমা কীর্তন করেই ক্ষান্ত হননি, সেই মহিমাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে রীতিমতো প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মোদীজির মতো মহান নেতা সম্পর্কে বিরোধী তথা সমালোচকরা যে সব কটু কথা বলেন, এই ‘মানপত্র’ তার সমুচিত জবাব দেবে। ‘নরেন্দ্র মোদীকে মাথায় তুলবেন না’, এই চেতাবনি দিয়ে মোদীজি কি ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখবেন? রাম রাম!

Advertisement

আত্মশ্লাঘা এখন রাজনীতির নায়কনায়িকাদের পরম ধর্ম। প্রজারা সম্বৎসর এবং অষ্টপ্রহর তাঁদের অতিকায় চিত্রপ্রদর্শনী এবং উচ্চরব বন্দনাগীতি দেখে-শুনে চমৎকৃত। এই বাজারে মোদীজির আপন দলের কর্মকর্তা ও কর্মকর্ত্রীরা তাঁর নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছেন, এ আর বেশি কথা কী? কিন্তু প্রশ্ন হল, এই উদ্যোগ কি নিছক অহৈতুকী ভক্তির প্রকাশ, না কি গূঢ় ও পরিকল্পিত রণকৌশল? লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়তে সাকুল্যে বছরখানেক বাকি। তার আগে কর্নাটক, ত্রিপুরা-সহ একাধিক রাজ্যে ভোট। অতএব নির্বাচনী অভিযানে দলের প্রধান হাতিয়ারটিকে নতুন করে প্রস্তুত করা আবশ্যক। সেই হাতিয়ার অবশ্যই নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ভাবমূর্তি। কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যে শাসক হিসাবে দলের ভূমিকা নিয়ে যে জনসাধারণের অন্তরে বিস্তর অসন্তোষ জমা হয়েছে, সে খবর দলনেতারা বিলক্ষণ জানেন। এই সত্যও তাঁদের অজানা নয় যে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মেরুকরণের রাজনীতি সম্ভবত আর অতীতের মতো কাজ করবে না। সুতরাং, পথ একটাই। মন্ত্র একটাই: সবার উপরে তিনিই সত্য।

কিন্তু যিনি দলের সর্বময় অধিনায়ক এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অদ্বিতীয় যন্ত্রী হিসাবে স্বীকৃত, দল তথা সরকারের ব্যর্থতা ও অন্যায়ের কলঙ্ক কি সর্বাগ্রে এবং সর্বাধিক মাত্রায় তাঁর মূর্তিতেই লাগবে না? কোনও ব্যক্তিনায়ককে বিপুল আকারে সুখস্বপ্নের আকাশে যদি তুলে ধরা হয়, তার মধ্যেই কি কঠিন বাস্তবের জমিতে তাঁর বিপুলতর পতনের সম্ভাবনা নিহিত থাকে না? ইতিহাসে তেমন পতন কি বারংবার দেখা যায়নি? অবশ্যই। এবং সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই এ কালের নায়কনায়িকারা তৎপর হয়েছেন নিজেদের চার পাশে অলৌকিক মহিমার বাতাবরণ নির্মাণে, রাজনীতি ও প্রশাসনের দৈনন্দিনতার সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব সৃষ্টিতে। তাঁরা একক শক্তিতে রাজ্যপাট চালান, কিন্তু সেই রাজ্যপাটের কোনও মালিন্য যেন তাঁদের স্পর্শ করে না। জগৎসংসার চালনা করেও ঈশ্বর যেমন সেই জগতের সমস্ত মালিন্যের ঊর্ধ্বে থাকেন। এই শাসকরা জানেন যে, ভারতীয় সমাজ আজও ভক্তিরসে টইটম্বুর। আর কে না জানে, ভক্তি স্বভাবতই বিচারবুদ্ধিহীন, ভক্ত তার ভগবানের কৃতি ও নীতির মূল্যায়ন করে না, করতে চায় না, আপন ভক্তিতে সে আপনি বিভোর থাকে। এই পরম ও চরম ভক্তিই বর্তমান শাসকদের প্রধান ভরসা। দিল্লি যথাস্থানেই আছে, কিন্তু নেহরু দূর অস্ত্।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন