KM Joseph

বিদ্বেষবিষতরঙ্গ

এই সূত্রে বিচারপতি আর একটি জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন— দৃশ্যমাধ্যমের ব্যাপক ও গভীর প্রভাবের কথা। বিশ্ব জুড়েই এখন লেখার অক্ষরের থেকে ছবির ভূমিকা অনেক বেশি প্রত্যক্ষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪৫
Share:

বিচারপতি কে এম জোসেফ। — ফাইল চিত্র।

এদেশ কোন দিকে চলেছে? কোন অভিমুখে?— কাব্যিকতা নয়, বরং অতি তীব্রতার সঙ্গে এই প্রশ্নটি ধ্বনিত হয়েছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি কে এম জোসেফ-এর মুখে। কোভিডের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে ‘ইউপিএসসি জেহাদ’— ভারতীয় টেলিভিশনে ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানো সংক্রান্ত এগারোটি পিটিশন শুনে তিনি নিজমুখে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন এই গভীর ভর্ৎসনাবাক্য। সমাজে বিদ্বেষবিষ ছড়ানোর পথ আটকানোর কী কী উপায় হতে পারে, সর্বোচ্চ আদালতে এই আলোচনাটি তো গুরুত্বপূর্ণ বটেই, কিন্তু তার সঙ্গে বিচারপতির প্রকাশ্য মন্তব্যটিও আলাদা করে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একটা মর্মন্তুদ আক্ষেপ সব নাগরিকের মনে আজ ছড়িয়ে পড়া জরুরি— দেশ কোন দিকে চলেছে? স্বাধীনতা লাভের পর পঁচাত্তর বছর কেটেছে, তার উদ্‌যাপনের ঘনঘটায় দুন্দুভি বাজছে— কিন্তু সে বাজনা কি ঐক্য-আনন্দের, না কি বিচ্ছেদ-বিদ্বেষ আতঙ্কের?

Advertisement

প্রচারমাধ্যমে যখন এই ভাবে সংখ্যালঘুবিদ্বেষের ঢেউ, তখন কার কাজ ছিল তাকে আটকানোর, প্রয়োজনে শাস্তি দিয়ে তাকে ঠিকপথে ফেরানোর? বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন: কী করছে ভারত সরকার এই বিরাট অন্যায় ও বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে? তার কি কোনও দায়িত্ব নেই? জাস্টিস জোসেফ সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ভারত সরকার কি কেবল ‘নীরব দর্শক’ হয়ে থাকবে, আর অন্যায়কারীরা অন্যায় করেই যাবে? বাস্তবিক, যে সমস্ত কথা আজকাল কিছু প্রচারমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারিত হয়, তার অনেকটাই কেবল অনৈতিক নয়, অসাংবিধানিক। কিন্তু সাড়ে সাত দশক বয়সি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে সংবিধান-বিরোধিতার এই অপার যজ্ঞ দেখেও টুঁ শব্দটি করে না, এটাই আসল সমস্যা। প্রচারমাধ্যমের স্খলন তো আছেই, কিন্তু রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য যে সংবিধানরক্ষা, সেটা মনে রাখা এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

এই সূত্রে বিচারপতি আর একটি জরুরি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন— দৃশ্যমাধ্যমের ব্যাপক ও গভীর প্রভাবের কথা। বিশ্ব জুড়েই এখন লেখার অক্ষরের থেকে ছবির ভূমিকা অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। এবং সেই দৃশ্যমাধ্যমকে ব্যবহার করে অনবরত জনসমাজের নানা অংশের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হলে তার কী সাংঘাতিক প্রভাব জনমানসে পড়তে পারে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সর্বোপরি, এই বিদ্বেষ-প্রচার কিন্তু কেবল বাক্যনির্ভর নয়— বিভিন্ন স্তরে তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, ছবি দিয়ে, উল্লেখ দিয়ে, আপাত-নিরীহ কিছু চিহ্ন বা ইশারা দিয়েই। মানুষের মনের অন্ধকার দিকটিকে নাড়া দিয়ে গরল তুলে আনার বহু পদ্ধতি আছে, মনে করিয়ে দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতি। প্রবল উদ্বেগের কথা, সেই সব পদ্ধতির প্রতিটিরই এখন অনবরত ব্যবহার চলছে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে। গণতন্ত্রে প্রচারমাধ্যমের স্থান যে কেমন ও কতখানি, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, চতুর্থ স্তম্ভের গুরুত্ব নিয়ে বহু দিন যাবৎ বহু চর্চা হয়েছে। মুশকিল এই যে, এই চর্চাও শেষ পর্যন্ত প্রচারমাধ্যমই অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। এমতাবস্থায় প্রচারমাধ্যমের আত্মসচেতন, বিবেকবান অংশটির দায়িত্ব অনেকখানি বেড়ে যায়, অনাচারকে বারংবার আলাদা করে বোঝানোর দরকার হয়ে পড়ে। আর এক বার সে কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন