Society

জ্যাঠামশায়ের নিদান

কোন অজুহাতে পেশার যুক্তি দিয়ে নাগরিকের মৌলিক ব্যক্তি-অধিকারের প্রশ্নটি ধূলিসাৎ করা যায়?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২২ ০৪:৫৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

ভারতীয় নাগরিকের পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কথায় কাজে কর্মে খাদ্যে পোশাকে সর্বদা তােক ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’, ‘সাংবিধানিক সুরক্ষা’ ইত্যাদি বড় বড় শব্দ উচ্চারণ করতে হয়— এবং কী দুর্ভাগ্য, তা সত্ত্বেও রক্ষা পাওয়া যায় না। কে কী পরবেন, কে কী খাবেন, সবই এখন ক্রমশ অন্য লোকের এবং বৃহৎ সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে— ব্যক্তির বাঁচাটা যেন অন্য ব্যক্তিসমূহের মতামতের উপরই নির্ভর করার কথা। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাঁতারের পোশাক পরিহিত ছবি সমাজমাধ্যমে দিয়েছিলেন। অভিযোগ, এই ‘অপরাধ’-এ তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হল। কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র সে ছবিটি দেখে ফেলায় তার অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে, ‘আপত্তিকর’ এবং ‘অশ্লীল’ ছবিটি দেখে নাকি তাঁর সন্তানের মন আহত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষও বোধ করলেন যে, শিক্ষিকার এ-হেন আচরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে। অভিযোগ, অতঃপর শিক্ষিকা ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। পুরুষতন্ত্র বজ্রনির্ঘোষে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল ফের।

Advertisement

এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রমী ঘটনা হলে এই সম্পাদকীয় লেখার প্রয়োজন হত না। কিন্তু অতি বড় দুর্ভাগ্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধরহিত, রক্ষণশীল সিরিয়াল-রসসিঞ্চিত সমাজে এখন এমনই দস্তুর। শিক্ষক-শিক্ষিকার পোশাক, তাঁদের আচরণ সংক্রান্ত নানাবিধ ফতোয়া জারির প্রবণতা অনেক পুরনো বিষয়। কথায় কথায় ভারতের সনাতন সংস্কৃতি ইত্যাদি ধুয়ো তুলে শিক্ষকদের জন্য রক্ষণশীল আচরণবিধি তৈরির চেষ্টাও পদে পদে পরিষ্কার। কিছু কাল আগেই রাজ্যে শিক্ষিকারা কর্মক্ষেত্রে শাড়ি পরবেন না সালোয়ার-কামিজ— তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। কেউ বলতে পারেন, এই তো বিরাট অগ্রগতির লক্ষণ: সালোয়ার-কামিজ থেকে বিতর্কের মুখ আপাতত ঘুরেছে সুইমিং কস্টিউমের দিকে! সমাজের স্বঘোষিত জ্যাঠামশাইরা যুগের প্রয়োজন থেকে পোশাক নির্বাচনের অধিকার, কিছুই মান্য করে চলার প্রয়োজন বোধ করেন না। বলা বাহুল্য, পুরুষের ক্ষেত্রে এ সব সমস্যা ওঠে না। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি কলুষিত হয় কেবল নারীর পোশাক দ্বারা। শিক্ষিকারা কি শিক্ষকদের চেয়ে কম নাগরিক অধিকারে মণ্ডিত? কোন অজুহাতে পেশার যুক্তি দিয়ে নাগরিকের মৌলিক ব্যক্তি-অধিকারের প্রশ্নটি ধূলিসাৎ করা যায়? কোন অধিকারেই বা কর্মক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষ কর্মীর ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলায়?

এবং শেষ পর্যন্ত, এই প্রশ্ন সংস্কৃতিরও প্রশ্ন। একবিংশ শতকে জীবনযাপনের সর্ব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের স্পষ্ট ছাপ এবং সেই ছাপের স্পষ্ট স্বীকৃতি। সাঁতারের সময়ে যে পোশাক জনপরিসরে পরা যায়, তার ছবিতে সমস্যা কোথায়? যে বয়ঃপ্রাপ্ত ছাত্রের মনে আঘাত লাগছে শিক্ষিকার পোশাক দেখে, তারই কি কিছু শিক্ষার দরকার ছিল না এ ক্ষেত্রে? অপরকে সম্মান করা, এবং নিজের রুচি অন্যের উপর না চাপিয়ে দেওয়ার শিক্ষা? বর্তমান ভারতে এই শিক্ষাটি দুর্লভ হয়েছে— রাষ্ট্রই রুচির বহুত্ব ও ব্যক্তির চয়নের অধিকারকে খর্ব করতে সিদ্ধহস্ত। সেই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে এই শিক্ষা দেওয়া আরও জরুরি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সচেতন দায়িত্বশীল উদার নাগরিক নির্মাণ। কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়টি সেই কাজে সার্বিক ভাবে ব্যর্থ হল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন