Editorial news

এই রাজনীতি সস্তা এবং অপরিণত

‘পদ্মাবতী’ ছবিকে নিষিদ্ধ করার আবেদন এ যাবৎ তিন বার খারিজ হয়ে গেল সুপ্রিম কোর্টে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৪১
Share:

আবার সেই বিপদ ঘণ্টাটা বাজল। সংবিধানের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং দায়বদ্ধ থাকার শপথ নিয়েছেন যাঁরা, সাংবিধানিক সীমারেখাটাকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে তাঁরাই লঙ্ঘন করে যাচ্ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ গোটা দেশকে মনে করিয়ে দিল, অনৈতিকতারও সীমা থাকা দরকার। একটি চলচ্চিত্রকে ঘিরে যা চলছে রাজ্যে রাজ্যে, তা যে অত্যন্ত অনৈতিক এবং অসাংবিধানিক, সে কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হল।

Advertisement

‘পদ্মাবতী’ ছবিকে নিষিদ্ধ করার আবেদন এ যাবৎ তিন বার খারিজ হয়ে গেল সুপ্রিম কোর্টে। শুধু আবেদন প্রত্যাখ্যানেই ক্ষান্ত থাকল না সুপ্রিম কোর্ট, ছবিটির বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে বা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, তা সর্বৈব অসাংবিধানিক বলেও সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল। অন্তত তিনটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মন্তব্য যে চূড়ান্ত অনাকাঙ্খিত, সে কথা শীর্ষ আদালত সরাসরি বলল। মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি ভর্ত্‌সনার সুরও সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

রাজপুত করণী সেনার হাত ধরেই প্রচারের আলো দেখেছিল ‘পদ্মাবতী’র বিরোধিতা। কিন্তু বিতর্ক যখন এক বড়সড় জনগোষ্ঠীর অস্মিতা সংক্রান্ত প্রশ্নকে ঘিরে, তখন মূল ধারার রাজনীতি আর কত ক্ষণই বা দূরে থাকতে পারে। অচিরেই সক্রিয় হতে শুরু করলেন নেতা-বিধায়ক-মন্ত্রী-সান্ত্রীরা, রাজপুত অস্মিতার স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন, দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য, হুঁশিয়ারি, নিদানের বান ডাকাতে শুরু করলেন। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সীমা ছাড়াল রাজস্থান, গুজরাত এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের হাত ধরে। পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও নাম লিখিয়েছেন একই খাতায়। প্রত্যেকেই জানিয়েছেন তাঁদের রাজ্যে ‘পদ্মাবতী’র প্রদর্শন হবে না। সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব ভুলে ভোট রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই চেষ্টারই সমালোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ধাক্কা দিয়েছে সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘনের ঔদ্ধত্যকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘পদ্মাবতী’ নিষিদ্ধ নয়, মুখ্যমন্ত্রীদের তিরস্কার করে ফের জানাল সুপ্রিম কোর্ট

‘পদ্মাবতী’ ছবিকে ঘিরে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমরা, তা বেনজির নয়। অপছন্দের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী রুখতে বা অস্বস্তিকর নাটক মঞ্চস্থ হওয়া ভেস্তে দিতে বা না-পসন্দ বই বাজার থেকে নিঃশেষে সরিয়ে ফেলতে এ দেশের রাজনীতিকরা অত্যন্ত পারদর্শী। জয়পুর, গাঁধীনগর, ভোপাল বা পটনা আজ শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। কিন্তু কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি বা চেন্নাইও যে এ ধরনের হস্তক্ষেপে বিন্দুমাত্র কম পারদর্শী নয়, সে প্রমাণ অতীতে বহু বারই মিলেছে। সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘনের বা নাগরিক অধিকার হরণের এই সব অপপ্রয়াস দেখতে অতএব অভ্যস্তই আমরা। বার বার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকেই আমরা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে উঠতে দেখি। বার বার কোনও না কোনও সাংবিধানিক স্তম্ভই সক্রিয় হয় এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে ধাক্কা দিতে। বার বার ভর্ত্‌সনা আসে। কিন্তু সেই সব উপসংহার থেকে এ দেশের রাজনীতি কোনও শিক্ষা নেয় না। সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের শপথ নিয়ে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য লঙ্ঘনের দায়েই অন্য কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ভর্ত্‌সিত হওয়া যে অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়, এ যে কর্তব্য পালনে অক্ষমতার নামান্তর তা এ দেশের রাজনীতিকদের বোধগম্য হয় না। অথবা বুঝেও বোঝেন না রাজনীতিকরা। সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুপুঙ্খরূপে বুঝে নিলে ভোটের তাগিদে বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ কমে আসে। সেই কারণেই এই সব দায়িত্ব ও কর্তব্যকে প্রয়োজন মতো অবহেলা করার কৌশলটাও রপ্ত করে রাখেন আমাদের দেশের রাজনীতিকরা।

এই অসাংবিধানিক রাজনীতি যে ভাবে বার বার ধাক্কা খাচ্ছে সাংবিধানিক কাঠামোয়, যে ভাবে বার বার তিরস্কৃত হচ্ছে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, তাতে এ বার এই সস্তার কৌশল পরিহার করাই রাজনীতিকদের পক্ষে সম্মানের হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের চেহারাটা তাতে আর একটু পরিণতও দেখাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন