পারভেজ মুশারফ।—ফাইল চিত্র।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে আদালতের সংঘাত আজ ইতিহাস। কিন্তু সে দিন যখন সবে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্র নিজের মতো করে বিকশিত হচ্ছে তখন থেকেই বিচারবিভাগ ও শাসন বিভাগের সংঘাত সৃষ্টি হয়। তবে সেই আদি লগ্ন থেকে পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা খুবই গভীরে, তা হল পাকিস্তানে বিচারব্যবস্থা সেনাবাহিনী দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।
২০০৭ সালের কথাই মনে করুন। পাকিস্তানের জন্য সেই বছরটা ছিল খুবই কঠিন। সেটা ছিল নির্বাচনী বছর। রূপান্তর পর্বও ছিল রাজনীতিতে। পারভেজ মুশারফ এক জন স্বৈরতন্ত্রী বলে মনে করছিল নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ এবং পিপিপি। আর তাই নিয়ে দু’দল বোঝাপড়াও শুরু করে দেয়। তিনি আর একটি মেয়াদের জন্য সেই একই সংসদে পুনর্নির্বাচিত হলেন জরুরি আইন প্রয়োগ করে। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জও জানালো বিরোধীরা। ২০০৭-এর ২ নভেম্বর সেই জরুরি আইন প্রয়োগ করাকে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান বিরোধী বলে আখ্যা দেয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে জুলফিকার আলি ভুট্টো।—ফাইল চিত্র।
দু’টি সরকারি অফিস, অর্থাৎ, প্রেসিডেন্টের অফিস এবং সেনাবাহিনীর প্রধান, এই দু’টি চাকরিই একসঙ্গে রক্ষা করাকেও অবৈধ বলে জানায় সুপ্রিম কোর্ট। অনেক দিন থেকেই বহু সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের বিদ্বজ্জন এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। সে সময় পারভেজের প্রেসিডেন্ট হাউসে গিয়ে দেখেছি, তিনি সাংবাদিক বৈঠক করছেন সামরিক পোশাকে। রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি সেনাপ্রধানের বাসভবনটিও শেষ দিন পর্যন্ত ছাড়তে চাননি। রাওয়ালপিন্ডির সেই বাসভবনে তাঁর প্রিয় কুকুরগুলিও থাকত। পাকিস্তানের এক প্রবীণ সাংবাদিক আমাকে তখন বলেছিলেন, ওই সামরিক পোশাকেই আছে পারভেজের শক্তি। ওই পোশাক আর রাওয়ালপিন্ডির বাড়িটি ছাড়লেই পারভেজ ক্ষমতাচ্যুত হবেন রাজনীতির কুর্সি থেকেও। রাজনীতির শক্তির পিছনে ছিল সামরিক শক্তিও। কিন্তু তা হলে সুপ্রিম কোর্ট কেন তাঁর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করল? এখানেই পাক রাজনীতির নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা। পারভেজ মুশারফের বিরুদ্ধেও পাক সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। পাক সেনাবাহিনী-আইএসআই-মোল্লাতন্ত্র মুশারফের উপর আস্থা হারায় এবং নতুন সেনাপ্রধান উঠে আসেন। ফলে সুপ্রিম কোর্টও সেনাবাহিনীর ক্ষমতাসীন মূল স্রোতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
২০০৭-এর ২৭ ডিসেম্বর বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়। রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এই ঘটনাও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁর স্বামী আসিফ জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টি-র চেয়ারপার্সন হন। ২০০৮-এর শেষে পিপিপি সহানুভূতি ভোটে ক্ষমতাসীন হয়। মনে রাখতে হবে, বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে। জেনারেল জিয়াউল হক তখন সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে পাক বিচার ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেন। এই সময় আদালতের ট্রায়াল সম্পর্কে পাক সংবাদ মাধ্যমেই লেখা হয়, ‘মার্ডার অফ আ ট্রায়াল’। এই কারণেই সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে পিপিপি-র কখনওই আস্থা ছিল না। এমনকী, বেনজিরের দল মনে করে, সুপ্রিম কোর্ট সিন্ধ-বিরোধী প্রতিষ্ঠান। বলা হয়, এটি ‘এথনোসেন্ট্রিক’ প্রতিষ্ঠান।
পারভেজ মুশারফ।—ফাইল চিত্র।
জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৭৮ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত। ’৮৫-তে প্রধানমন্ত্রী হন খান মহম্মদ জুনেজো। ১৯৭৩-এ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আসে। গোটা সংবিধানের ১৯টি অনুচ্ছেদে এই সংশোধন প্রভাব ফেলে। ৫৮(২) বি অনুচ্ছেদে জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত এই সংশোধনের আওতায় আসে। এই ঘটনা পাকিস্তানের আইনি ব্যবস্থাই বদলে দেয়। প্রেসিডেন্টের হাতেই অধিক ক্ষমতা অর্পিত হয়। ১৯৮৮-র মে মাসে জেনারেল জিয়া প্রধানমন্ত্রী জুনেজোকে বরখাস্ত করেন। আবার সুপ্রিম কোর্ট তাঁর পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এর ফলে পাকিস্তানের রাজনীতির স্থায়িত্ব নষ্ট হয়। মজার ব্যাপার, ১৯৮৮-র অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, জিয়ার বরখাস্তের ওই সিদ্ধান্ত আইনবহির্ভূত। যদিও আদালত আদেশ প্রত্যাহার করেনি, কারণ, ভোটের সময় হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে জিয়াউল হক তাঁর কৃতকর্মের জন্য আর শাস্তি পাননি।
জিয়ার মৃত্যুর পর বেনজির ভুট্টো বসেন প্রধানমন্ত্রীর তখতে। পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ভুট্টোকে সরান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইশাক আলি খান। তিনি সংসদ ভেঙে দিয়ে ভুট্টোকে বরখাস্ত করে দেন। এই সময় কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট চুপ করে থাকে। সে সময় কোনও সক্রিয় ভূমিকা তারা গ্রহণ করেনি। ১৯৯০ সালে নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় আসেন। তিন বছর পর গুলাম ইশাক খান আবার সংসদ ভেঙে দেন। তিনি ভোট ঘোষণা করে দেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলে, এই নির্দেশ অবৈধ।
১৯৮৬ সালে প্রচারে বেনজির ভুট্টো।—ফাইল চিত্র।
’৯৩-এর এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর সংঘাতে দু’জনেই ইস্তফা দেন। ’৯৩ সালে পিপিপি এবং এমকিউএম আবার ক্ষমতায় আসে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘারি সেই সরকার ভেঙে দেন দুর্নীতির অভিযোগে। সে সময়েও সুপ্রিম কোর্ট ছিল মৌন। ১৯৯৭-এ নওয়াজ প্রবল পরাক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্ট তখন পাঁচ জন বিচারপতিকে নিয়োগ করে নওয়াজের বিরুদ্ধে তদন্ত করায়। এই পাঁচ জন বিচারপতি নওয়াজ-বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার মামলা রুজু করে। আদালতের মধ্য মুসলিম লিগ কর্মীরা ঢুকে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। এর পর পারভেজ যখন নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তখনও বিচারব্যবস্থা পারভেজের পক্ষেই ছিল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকেও সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ বছর আগে এই একই ভাবে সরিয়ে দেয়। প্রধান বিচারপতি ইফতিকার চৌধুরী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে শত্রুতার কারণে বিচারব্যবস্থাকে এ ভাবে গলা টিপে হত্যা করেন।
সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আসমা জাহাঙ্গির বলেছেন, আদালতের এই বিচার ভবিষ্যতের জন্য মস্ত বড় কলঙ্ক হল। কিছু দিন আগে পাক সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের হয় যে, আইএসআই ভোটের সময় কোনও কোনও নেতাকে প্রচুর টাকা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলাকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। তাই পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা বরাবরই পাক সেনাবাহিনীর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। এখন দেখার, নওয়াজের ঘনিষ্ঠ শাহিদ খকন আব্বাসি অন্তর্বর্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাক সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হয়। যদিও নওয়াজের দল চায়, আগামী দেড় মাসের মধ্যে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসুন নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ। তবে যিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকুন না কেন, তিনি পাক সেনাবাহিনীকে কতটা সামলাতে পারবেন, কত দিন পারবেন সেটাই দেখার।