এক বিদেশি শিশু-মনস্তত্ত্ববিদ বলিলেন, মধ্যবিত্ত দম্পতির সন্তানেরা শ্রেণিকক্ষে সাধারণত দুর্ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত হইতেছে। ইদানীং অভিভাবকরা সন্তানদের অতিরিক্ত যত্ন ও মনোযোগ দিবার ফলে শিশুরা যে ক্রমশ অতি মাত্রায় তাঁহাদের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছে এবং এক সময় প্রাপ্তবয়স্ক হইয়াও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে অপারগ হইতেছে, তাহা পূর্বেই কিছু গবেষক বলিয়াছিলেন। এই মনস্তত্ত্ববিদ বলিতেছেন, উহা তো সত্য বটেই, তদুপরি এই ধরনের সন্তানেরা স্কুলে আসিয়া সমষ্টির মধ্যে পড়িয়া কিছু দিনের মধ্যেই বিপন্ন বোধ করিতেছে। কারণ এইখানে তাহাদের মাথায় তুলিয়া সমাদর করা হইতেছে না। তুমিই শ্রেষ্ঠ বলিয়া আত্যন্তিক প্রশস্তিতে ভরাইয়া দেওয়া হইতেছে না। বিদ্যালয়ে যে পড়াশুনা ভাল করিতেছে, সে ভাল নম্বর পাইতেছে। যে ভাল খেলিতেছে, সে দলে সুযোগ পাইতেছে। যে মানুষটি বাড়িতে রাজার ন্যায় বিচরণ করে, যাহাই করে তাহাতেই করতালি ধ্বনিত হয়, যাহাই চাহে তখনই তাহা হইহই করিয়া সম্মুখে হাজির করা হয়, সে এই ধরনের আচরণে অত্যন্ত অপ্রীত বিস্মিত আহত হইতেছে। ভাবিতেছে, তবে কি এই স্কুল জায়গাটির লোকেরা আমার মূল্য সম্পর্কে অবহিত নহে, না আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অপমান করিতেছে? আমি বল খেলিব, কিন্তু অন্যকে ভাগ দিব কেন? সমগ্র পৃথিবী কি কেবল আমাকে সেবা করিবার জন্যই সৃষ্ট হয় নাই?
বহু সাধারণ মানুষও লক্ষ করিয়া থাকেন, ইদানীং অণু-পরিবারের একমাত্র সন্তান অতি আদর পাইয়া বখিয়া যাইতেছে। তাহার উপর পিতামাতার সকল প্রত্যাশা কেন্দ্রীভূত হইতেছে বলিয়া তাহার যেমন শৈশব বলিয়া আর কিছুই থাকিতেছে না, তাহাকে রেনেসাঁস-মনুষ্য হইবার নিমিত্ত অঙ্কন আবৃত্তি ব্যাডমিন্টন সাঁতার গণিত বিজ্ঞান যুযুৎসু কারাটে শিখিতে হইতেছে, তেমনই, পিতামাতার সকল আদরের কেন্দ্র হিসাবে সে দুই বেলায় দুইটি উপহার হস্তগত করিয়া জলখাবার খাইতেছে। তাহার ভাইবোন নাই, বন্ধুও নাই, পাড়ায় খেলিবার মাঠও নাই, সে বৈকালে বাড়িতে বসিয়া টিভি দেখে ও নিজ খেলনা লইয়া একা খেলিতে থাকে। সমষ্টি সমাজ সম্মেলন বিষয়ে তাহার ধারণাই তৈয়ারি হয় না। মধ্যবিত্ত পিতামাতার হস্তে পয়সা রহিয়াছে, দুই জনেই চাকুরি করিতেছেন বলিয়া সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিয়া অপরাধবোধ রহিয়াছে, বড়লোকিয়ানার আকাঙ্ক্ষায় ধনীর সন্তানের সমান ক্রীড়া-উপকরণ নিজ সন্তানকে দিবার প্রবণতা রহিয়াছে, তাই খুদে সম্রাটের সকল দাবিই দ্রুত পূর্ণ হইতেছে। ক্রমে সে এমন ধারণার বশবর্তী হইতেছে, কখনও কোনও কিছুই তাহার অনায়ত্ত থাকিতে পারে না। তাই বাস্তবের অপ্রাপ্তি-সংকুল পৃথিবীতে গিয়া পড়িয়া, তড়িদাহত হইতেছে। কারণ সেইখানে সে অনেকের মধ্যে এক, কখনওই একমাত্র নহে। পিতামাতা তাহাকে ঘিরিয়া নিরাপদ জীবন দিতে গিয়া, তাহার বর্ম গজাইবার সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করিয়া দিয়াছেন, ফলে সে সর্বাধিক অসহায় অপ্রস্তুত যোদ্ধা হিসাবে জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হইতেছে।
তবে কি ইহার সমাধান, পূর্বের ন্যায় অনেকগুলি শিশু উৎপাদনের অভ্যাসে ফিরিয়া যাওয়া? বহু সন্তান থাকিলে অভিভাবকের মনোযোগ স্বতঃই বিভক্ত হয়, কাহাকেও বিশেষ তোষণের সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বহু সন্তান হইলে জনসংখ্যা বাড়িবে, দেশেরও ক্ষতি ঘটিবে, প্রতিযোগিতাও হইবে প্রবলতর, ফলে নিজ সন্তানকে এক নম্বর করিবার প্রয়াসও বৃদ্ধি পাইবে। তবে কি এক সন্তান হইলেও তাহাকে অতিরিক্ত আদর না দিবার অভ্যাস আয়ত্ত করিতে হইবে? কিন্তু যে পরিবারে মেলামেশার মানুষ ক্রমশ কমিতেছে, প্রতিবেশীদের সহিত বাক্যালাপ নাই, জনযোগের পরিবর্তে যাঁহারা নিজ কম্পিউটারের আয়তক্ষেত্রে জীবন ঢালিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা সন্তান ব্যতীত আদর দিবেন কাহাকে? তাই সন্তান এক বার হাঁচিলেই তাঁহারা বৈদ্য ডাকেন, টিফিন-কালে সে একটি ঠোনা খাইলেই অন্য বন্ধুর বাড়ি দৌড়ান ঝগড়া করিতে। তাঁহারা চাহিতেছেন, এই ব্যক্তিটি একটিও আঁচড় ব্যতিরেকে সমগ্র জীবন কাটাইবে। সন্তানকে যে বঞ্চিতও করিতে হয়, ঠিক সময় অনাদরও করিতে হয়, বুঝাইতে হয়, পৃথিবী এক নিরবচ্ছিন্ন রাঙা রূপকথা নহে, ইহা আধুনিক অভিভাবকদের মাথায় ঢুকে না। তবে কি, তাঁহাদের অতি-কড়া অভিভাবকরা ইহার জন্য দায়ী? মনস্তত্ত্ববিদরা এক বার ভাবিয়া দেখিবেন কি?
যৎকিঞ্চিৎ
বিশ্ব মিট-এ বোল্ট ১০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হলেন না। হলেন জাস্টিন গ্যাটলিন। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে গ্যাটলিনকে যাচ্ছেতাই টিটকিরি। সত্যিই তো, ওঁর কি উচিত ছিল না, পৃথিবীর সব্বাই প্রাণপণে যে রূপকথাটি চাইছিলেন, সেটাই ঘটতে দেওয়া? অবশ্য দ্বিতীয় যিনি হয়েছেন তাঁরও দোষ, তবু প্রথম হওয়াটা জঘন্য অপরাধ। ভুললে চলবে না, খেলা আসলে বিনোদন, আর সেখানে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ না হলে বক্স অফিসের বিপদ। এবং আধুনিক দুনিয়া বক্স অফিস ছাড়া আর কী?