দেশভক্তি নামক বস্তুটি নাকি হৃদয়ে ভরিয়া আপনি আপ্লুত হইবার মতো সহজ নহে। তাহা নাকি রীতিমতো প্রদর্শন করিবার বিষয়। অন্যথায়, নূতন ভারতের চোখে নাগরিকের দেশভক্তি কিছু কম ঠেকে। তখন তাহাকে চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া, প্রয়োজনে শারীরিক নিগ্রহ করিয়া দেশভক্তির পাঠটি শিখাইয়া দিতে হয়। সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং সঙ্গীত চলাকালীন প্রতিটি দর্শকের দাঁড়াইবার বাধ্যবাধকতা দেখিয়া তাহাই সিদ্ধান্ত করিতে হয়! সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাকয়েক প্রাক্তনী সেই বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করিবার সাহস দেখাইয়া জাতীয় সঙ্গীত চলিবার সময় রীতিমাফিক উঠিয়া না দাঁড়াইলে, তাঁহাদের ‘দেশভক্তি’র পাঠটি অন্যদের কাছ হইতে শিখিতে হইল। গালমন্দ, বিদ্রুপের সঙ্গে মিলিল পড়শি ‘শত্রু’ দেশে চলিয়া যাইবার মহামূল্যবান উপদেশও।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। অকুস্থলটি খাস কলিকাতার প্রেক্ষাগ়ৃহ বলিয়া কিছু ধাক্কা লাগিতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষিতে দেখিলে বুঝা যাইবে ইহা নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। পূর্বেও অন্যান্য রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন উঠিয়া না দাঁড়াইবার ‘অপরাধ’-এ অপরাধী গুরুতর শাস্তি পাইয়াছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও সেই হেনস্থার হাত হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই। অথচ, সুপ্রিম কোর্ট এই বৎসরের গোড়াতেই স্পষ্ট করিয়াছে, সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বাধ্যতামূলক নহে। এবং এই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত তাহার ২০১৬ সালের রায় হইতে সরিয়া আসিয়া কেন্দ্রের বিবেচনার উপরই বিষয়টি ছাড়িয়াছে। ২০১৬ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেরই রায় অনুযায়ী প্রতিটি সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বাধ্যতামূলক করা হইয়াছিল। কিন্তু বিষয়টি লইয়া দেশব্যাপী চরম বিতর্কের মুখে রায় পুনর্বিবেচনা করিয়া সুপ্রিম কোর্টই আবার স্পষ্ট করিয়াছে, জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন কেহ উঠিয়া না দাঁড়াইলে তাঁহার দেশভক্তি কম পড়িবে না। সংবিধানেও এই সংক্রান্ত কোনও নির্দিষ্ট আইন নাই, মহাত্মা গাঁধীও ইহা মানিতেন না। কিন্তু কলিকাতার প্রেক্ষাগৃহের ঘটনা প্রমাণ করিল ভারতে সাম্প্রতিক কালে যে দেশপ্রেমের জোয়ার আসিয়াছে, তাহাতে আদালতের যুক্তিও দাঁত বসাইতে পারে না।
আশ্চর্য নহে। যে দেশের সরকার জাতীয়তাবাদ বলিতে ক্ষণে ক্ষণে পড়শি রাষ্ট্রের প্রতি হুঙ্কার বুঝায়, সেই দেশে দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটি খানিক মোটা দাগের হইবে বটেই! ক্ষমতায় আসিবার পর হইতেই আপামর ভারতবাসীকে দেশভক্তির পথে ধরিয়া রাখিতে বহু বিচিত্র নিদানের ব্যবস্থা করিয়াছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। নাগরিক নিরুপায়। জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকায় মুড়িয়া রামায়ণ, মহাভারতের যুগের অসাধারণ বৈজ্ঞানিক কীর্তির উদাহরণ সহযোগে তাহাকে এমন ভাবে দেশভক্তির পাঁচনটি নিয়মিত খাওয়ানো হইতেছে যে অন্য যুক্তি ভাবিবার বোধটুকুও সে হারাইয়াছে। প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সঙ্গীত বাজাইবার সুপ্রিম কোর্টের পূর্বোক্ত রায়টিও সেই পাঁচনেরই অংশবিশেষ মনে করিয়া নির্বিবাদে তাহাকে হজম করিতেছে এবং দিকে দিকে পাকিস্তানের চর খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। নূতন রায়টি তাহাদের বধির কানে এখনও প্রবেশের পথ পায় নাই।