সময়ের খরা

কথাগুলি শুনিয়া সায় দিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সমাজমাধ্যম আসিবার পূর্বে কেহ কি কান চুলকাইয়া দিন কাটাইয়া দিত না? কেহ কি অকারণে দূরবর্তী বায়স নিরীক্ষণ করিয়া উর্বর দিনগুলিকে ছিন্নপত্রের তরণির ন্যায় ভাসাইয়া দেয় নাই?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share:

হযবরল গ্রন্থে, কাক জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি? ...আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করবার যো নেই।...’’ অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড গ্রন্থেও এক খরগোশ হন্তদন্ত হইয়া ক্রমাগত বলিতেছিল, ‘‘ওঃ ডিয়ার! ওঃ ডিয়ার! আই শ্যাল বি টু লেট!’’ এই ‘যে-মিনিট যায়, ফিরাইব তায় কেমনে’ হাহাকার সাম্প্রতিক যুগের এক বৃহৎ লক্ষণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহাকে অনেকে নাম দিয়াছেন, ‘টাইম ফেমিন’ বা সময়ের খরা। মানুষে নাকি প্রচুর কাজ লইয়া এমন ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িতেছে যে কখন কী কাজ করিবে কিছুতেই বুঝিতে না পারিয়া, সকলই তালগোল পাকাইয়া কিছুই তেমন করিয়া উঠিতে পারিতেছে না, আর তাহা হইতে উদ্ভূত মানসিক বিপর্যয়ের ফলে তাহার উদ্বেগ বাড়িতেছে, অনিদ্রা ঘটিতেছে, ওজন বাড়িতেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বহু অ্যাপ নির্মিত হইয়াছে, বক্তৃতা হইতেছে, ২০১৭ সালে একটি সমীক্ষাতেও বলা হইয়াছে, অধিক আয় করিয়াও মানুষের মনে সুখ নাই, কারণ কর্তব্য কিছুতেই নির্দিষ্ট সময়ে না সারিতে পারিবার ঝঞ্ঝাট তাহাকে তাড়া করিয়া বেড়াইতেছে। সমাধান হিসাবে কেহ বলিতেছেন, অ্যাপগুলিতে প্রথমেই করণীয় বিষয়গুলি লিখিয়া ভরিয়া দিতে, তাহার পর অ্যাপের পরামর্শ অনুয়ায়ী চলিতে। কেহ বলিতেছেন, মানুষের এই সমস্যা জন্মায়, কেবল সকল কাজ নিজেকে করিতে হইবে এই উদ্ভট বাধ্যতার বশে। অর্থব্যয় করিয়া অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন কাজ অন্যকে দিয়া করাইয়া লইবার পদ্ধতি স্বস্তিপ্রদ। কেহ অবশ্যই, সমাজমাধ্যমের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। তালিকা প্রস্তুত হইয়াছে, আমরা গড়ে প্রতি দিন ২.৩৪ ঘণ্টা ই-মেল পড়ি, ৩৭ মিনিট ফেসবুক দেখি, ৪০ মিনিট দেখি ইউটিউব, ইত্যাদি।

Advertisement

কথাগুলি শুনিয়া সায় দিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সমাজমাধ্যম আসিবার পূর্বে কেহ কি কান চুলকাইয়া দিন কাটাইয়া দিত না? কেহ কি অকারণে দূরবর্তী বায়স নিরীক্ষণ করিয়া উর্বর দিনগুলিকে ছিন্নপত্রের তরণির ন্যায় ভাসাইয়া দেয় নাই? কেহ কি পরীক্ষার আগের দিন, দুই কোটি টাকা অকস্মাৎ ক্রোড়ে আসিয়া পড়িলে ঠিক কী ভাবে তাহা ব্যয় করিবে তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রচনা করে নাই? রবীন্দ্রনাথের সময়েও তো ২৪ ঘণ্টায়ই দিন হইত, তাঁহাকে বাড়তি সাত-আট ঘণ্টা দেওয়া হইত না। তথাপি তিনি কী করিয়া এত কাণ্ড করিতে পারিলেন, যেখানে সহস্র বাঙালি কবি ‘এই বার একখানি মহাকাব্য-মুদ্গর হানিব’ ভাবিয়া ভূমিকাটুকুও শেষ করিতে পারিল না? চির কালই কিছু মানুষ সময়কে ব্যবহার করিতে পারিয়াছে, অধিকাংশ লোক পারে নাই। ইহা সাম্প্রতিক অসুখ হইতে যাইবে কেন? হঠাৎ একটি গালভরা ইংরাজি নাম দিয়া কিছু লোক যদি সমস্যা নিরসনের গুরুঠাকুর সাজিয়া বসেন, তাহা হইলে যাঁহারা হাঁ করিয়া সেই কথা শুনিতেছেন, তাঁহাদের সময় নষ্টের শখের দিকে নজর দিবার প্রয়োজন।

তাহার অপেক্ষা জরুরি প্রশ্ন হইল, ‘‘ওই ওই সময় চলিয়া যাইল রে, উহাকে যথেষ্ট খাটাইয়া লইতে পারিলাম না’’— হাহাকারটি জন্মিতেছে কোথা হইতে? সময় আপনমনে চলিয়া যাইবে, আমরা টিভি দেখিয়া ও গজল্লা করিয়া জীবন কাটাইব, ইহাই তো নিয়ম। আসলে, মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহসা এমনই বাড়িয়া গিয়াছে, সে আর রকে বসিয়া আড্ডা মারিয়া শান্তিতে থাকিতে পারিতেছে না। সে পাটিগণিতের হিসাব করিতে বসিতেছে, ও যদি এত বয়সে দুইটি গাড়ি করিয়া ফেলিতে পারে, আমি তবে পাঁচ বৎসর অধিক বাঁচিয়া একটিমাত্র গাড়িতে সন্তুষ্ট থাকি কেমনে? ‘পণ্য হাতাইলে সুখ ঘটে’ এই সমীকরণে চলিতে চলিতে সমগ্র জগৎ নিজেকে মাপিতে শিখিয়াছে কেবল বস্তুগত সাফল্যের নিরিখে। এবং ভাবিতেছে, অধিকাংশ মুহূর্ত যদি নিংড়াইয়া ব্যবহার করিতে পারিতাম, তবে আরও বস্তু আসিয়া আমার সম্পত্তির তালিকায় যোগ দিত! তাহা হইলেই সুখ আসিত কি না, সন্দেহ, কারণ কখন সে এই বস্তুগুলিকে ভোগ করিত? তাহার ভায়রাভাই আরও এক বাড়তি বস্তু সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছে কি না, এই দুর্ভাবনা আসিয়া তো তাহাকে নিশ্চিন্তে এসি-কক্ষে ঘুমাইতে দিত না। ফলে খরা হইয়াছে বটে, তাহা সময়ের নহে, সাধারণ বোধের। মনোভঙ্গির। মানুষ যদি অহেতুক আনন্দে ঝলমলে রৌদ্র দেখিয়া হাসিয়া উঠিতে পারে, তাহা হইলে তাহার সময় নষ্ট হয় নাই। সেই অহেতুক আনন্দের মুহূর্তগুলি কিউবিক্‌ল-এ বসিয়া ক্লিষ্ট মুখে প্রবল চার্ট কষিলে জোগাড় হয় না, তাহার জন্য মুখ তুলিয়া আকাশের দিকে তাকাইবার প্রাচীন অভ্যাসে শান দিতে হয়।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা ভেবে অনেকেই ঠিক করেছেন, সপ্তাহে দু’দিন চান করবেন, আর শীতকালটা তো পুরো চান বাদ। আশির দশকের এক ভারতীয় বিজ্ঞাপন নতুন করে নজর কাড়ছে, যেখানে তরুণ দম্পতি বলছেন, আমরা জল বাঁচাবার জন্যে প্রায়ই একসঙ্গে স্নান করি। অনেকে সকাল থেকেই তরিবত করে অন্য পানীয় খেয়ে জল বাঁচাচ্ছেন। বহু গৃহবধূ সিরিয়ালের মেলোড্রামা দেখেও প্রাণপণ কান্না চেপে আছেন। কিছুতে জল খরচা করবেন না। কে বলে, ভারতীয় নাগরিক দায়বদ্ধ নন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন