মেশিন যদি আগাম ফল জানায়

সহজ ভাষায় বললে, অতীতের বড় সংখ্যক অভিজ্ঞতাকে একত্র করে একটি যন্ত্রের মধ্যে পুরে দিলে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে যন্ত্রটি কেমন ভাবে ভবিষ্যতের ঘটনাবলিকে আগেভাগে অনুমান করতে পারবে, মেশিন লার্নিং সেই বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে।

Advertisement

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৮ ০০:৪৭
Share:

বিশ্বকাপে প্রিয় দল জার্মানির বিদায়ে হতাশ হয়েছেন? দুঃখ করবেন না। সান্ত্বনা পান এই ভেবে যে জার্মানি যদি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠত, তা হলে বিশ্বকাপ জিতত তারাই। এমনটাই দাবি করছেন রাশিবিজ্ঞানী এবং কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদরা। চলতি বিশ্বকাপে তাঁদের গণনা বহু ক্ষেত্রেই অভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। এমনকি শেষ ষোলোতে কারা যাবে, কোয়ার্টার ফাইনালে কারা উঠবে ইত্যাদি বিশ্লেষণে চমকে দেওয়ার মতো ভবিষ্যদ্বাণী করছেন তাঁরা।

Advertisement

সহজ ভাষায় বললে, অতীতের বড় সংখ্যক অভিজ্ঞতাকে একত্র করে একটি যন্ত্রের মধ্যে পুরে দিলে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে যন্ত্রটি কেমন ভাবে ভবিষ্যতের ঘটনাবলিকে আগেভাগে অনুমান করতে পারবে, মেশিন লার্নিং সেই বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে। বর্তমানে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা মেশিন লার্নিংকে প্রয়োগ করছেন অভিনব এবং আপাত ভাবে অবিশ্বাস্য কিছু সমস্যার সমাধানে। হৃদরোগ আক্রমণ করার আগেই সতর্কবার্তা বা অপরাধ ঘটবার বেশ কিছু আগেই পুলিশকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে হবে। মুশকিল আসান হিসেবে মেশিন লার্নিং! তা বলে বিশ্বকাপের ফলাফলকেও কি আগাম বলে দেওয়া সম্ভব?

বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাক্‌স-এর অর্থনীতিবিদ এবং রাশিবিজ্ঞানীরা মিলে প্রতি বিশ্বকাপের সময়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। তাঁদের গণনা অনুসারে, বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা এ বার সব চেয়ে বেশি ছিল ব্রাজ়িলের। তবে গোল্ডম্যান স্যাক্‌স ফাইনালে ব্রাজ়িলের বিরুদ্ধে জার্মানিকে বাজি ধরেছিল। সম্ভবত এই অঘটনের বিশ্বকাপ অনেক অঙ্কেরই গরমিল করে দিয়েছে। কিন্তু রাশিবিজ্ঞানের এই ধরনের মডেলের মজাটা হল, প্রতিটা খেলা শেষ হওয়ার পরেই সেই ফলাফলকে নিজের সিস্টেমের মধ্যে বিশ্লেষণ করে নিয়ে তার ভিত্তিতে নতুন করে গণনা শুরু করা যায়। এবং এই বার বার করে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ফলাফল থেকে শিখতে শিখতে মডেলটি হয়ে ওঠে আরও বেশি নিখুঁত। আপাতত বিজ্ঞানীরা তাই ব্যস্ত নকআউটের ফলাফল দিয়ে মডেলকে আরও ‘শিক্ষিত’ করে তোলায়। যাতে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি ত্রুটিহীন ফলাফল দেওয়া যেতে পারে। তবে তাঁদের থেকেও বেশি চমকপ্রদ গণনা করেছেন জার্মানির বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

জার্মানির ডর্টমুন্ডের একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গণিতবিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী মিলে অতীতের বিভিন্ন ফুটবল ম্যাচ নিয়ে নিয়মিত বিশ্লেষণ চালান। ফলস্বরূপ, ২০১৪ সালে তাঁরা নির্ভুল ভাবে বলে দিতে পেরেছিলেন যে জার্মানি বিশ্বকাপ জিতবে। শুধু তা-ই নয়, ২০১২ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফলাফলও নিখুঁত ভাবে মিলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। এমনকি কোন কোন দল ফাইনাল খেলবে সেটাও বলে দিয়েছিলেন হুবহু।

২০১৮ সালে তাঁদের গণনা অনুযায়ী, জার্মানির একটা বড় সম্ভাবনা ছিল নকআউট স্টেজের আগেই বিদায় নেওয়ার। তাঁদের পেপার প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বকাপ শুরুর এক সপ্তাহ আগে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছিলেন যে, জার্মানি যদি কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠতে পারে, তা হলে তারাই হবে কাপের দাবিদার। অপর দিকে গ্রুপ স্টেজের ২৪টি খেলার মধ্যে ১৫টির ফলাফল ঠিক ভাবে আগাম বলে দিয়েছেন তাঁরা। আটটি গ্রুপের মধ্যে ছ’টি গ্রুপের ক্ষেত্রে মিলিয়ে দিয়েছেন কোন কোন দল নকআউট পর্বে যাবে। ভ্রান্ত হয়েছেন শুধু জার্মানি, কলম্বিয়া আর জাপানের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ষোলোটি দলের মধ্যে তেরোটিকে ঠিক ভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। সাফল্যের হার ৮০ শতাংশের কিছুটা বেশি। আর ব্যর্থতা? তাঁরা বলেছিলেন যে স্পেনের জেতার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। স্পেন ছিটকে গিয়েছে। সেই হিসেবে গণনাকে অসফল বলা যায়। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

কী ভাবে করা হয় এমন গণনা? গোল্ডম্যান স্যাক্‌স এবং ডর্টমুন্ড, দুই দলের বিজ্ঞানীরা প্রথমে বিচার করেছেন একটি দলের কোন কোন উপাদান তাদের খেলায় প্রভাব ফেলতে পারে। ডর্টমুন্ডের গবেষকেরা এ ক্ষেত্রে সেই দেশের মাথাপিছু গড় আয়, জনসংখ্যা, বুকি-রা সেই দেশের পক্ষে অথবা বিপক্ষে কত বাজি ধরছেন, সেই দেশের ফিফা র‌্যাঙ্কিং কত, দলের মধ্যে কত জন ফুটবলার একই ক্লাবের হয়ে খেলেন, তাঁদের গড় বয়স কত, সেই দলের কোচ বিদেশি কি না, কত দিন ধরে আছেন, এ রকম ষোলোটি উপাদান নিয়েছিলেন। তাদের প্রত্যেকটির প্রভাব ফেলবার ক্ষমতা অবশ্যই ভিন্ন। অতীতের খেলাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বুকিদের ধরা বাজির পরিমাণ এবং ফিফা র‌্যাঙ্কিং। আবার কোচ কোন দেশের অথবা সেই দেশটি কোন মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত, এগুলো খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।

অপর দিকে গোল্ডম্যান স্যাক্‌সের বিচার্য ছিল দেশটির ফিফা র‌্যাঙ্কিং, প্রত্যেকটি অন্য দলের বিরুদ্ধে সেই দলের অতীত রেকর্ড, অদূর অতীতে কত গোলে জয় অথবা পরাজয় ঘটেছে, তাদের খেলোয়াড়দের আলাদা আলাদা র‌্যাঙ্কিং ইত্যাদি। এই সমস্ত উপাদানকে দুই দলের বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ‘র‌্যান্ডম ফরেস্ট’ নামক একটি মডেলে।

র‌্যান্ডম ফরেস্ট হল বিভিন্ন ধাপে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তের একটি সমাহার। ফুটবলারদের দক্ষতা, তাঁদের দেওয়া গোলের মোট পরিমাণ, গত দুই বছরে দেশের পারফরম্যান্স ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নানাবিধ সিদ্ধান্ত পাওয়া সম্ভব। সেগুলিকে এক সঙ্গে এনে কী ভাবে বিশ্লেষণ করলে একটি যুক্তিগ্রাহ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়, তার একটি গাণিতিক রূপ হল র‌্যান্ডম ফরেস্ট। র‌্যান্ডম ফরেস্ট চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে দেখাচ্ছে প্রতিটি খেলায় কোন দলের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কত। যে হিসেবে ক্রোয়েশিয়া যে এ বার অনেক দূর এগোবে, এমনতর সম্ভাবনাকেও আগে থেকে বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

তা হলে স্পেনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হলেন কেন? তার কারণ, এই ধরনের মডেল কাজ করার প্রধান শর্তই হল যে তাকে প্রভাবিত করে এমন উপাদানগুলো চরিত্রগত ভাবে অপরিবর্তিত থাকবে। ডর্টমুন্ডের পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে ৮ জুন। আর বিশ্বকাপ শুরুর দুই দিন আগে স্পেনের কোচ দুম করে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছেন। এসেছেন নতুন এক জন। কোচের তথ্য, বিশেষত তিনি দলের সঙ্গে কত দিন সময় কাটাচ্ছেন— সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক। তাই ঘেঁটে গিয়েছে সমস্ত হিসেব। এর দায় গণিতের উপর চাপানো উচিত নয়, বক্তব্য ডর্টমুন্ডের গবেষকদের।

এ দিকে, ফিফার নিজস্ব রাশিবিজ্ঞানীরা আবার জার্মানিকে ফেভারিট বলেছিলেন। যেটা লক্ষ করার, তিন দলের বিজ্ঞানীরাই জার্মানিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে রেখেছিলেন, অথচ তারা প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছে। এটাকে হয়তো গণনার একটা দুর্বলতা বলা যায়। র‌্যান্ডম ফরেস্টের বৈশিষ্ট্য হল, অব্যবহিত অতীতের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রয়োগ করে। ২০১৪ সালে জার্মানি বিশ্বকাপ জিতেছিল বলেই এ বারেও তাকে অত দূর এগোতেই হবে, এমন সিদ্ধান্ত সকলেই টেনেছেন। আবার কোনও দলই জাপানকে গুরুত্ব দেয়নি। কারণটাও একই। পূর্বের ইতিহাস জাপানের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা কিছু বলছে না। গোল্ডম্যান স্যাক্‌স তাই স্বীকার করেছে, ফুটবলের মতো সম্ভাব্যতার একটি শিল্পে এ রকম অতিরিক্ত অতীতনির্ভরতা ভুল পথে চালিত করতে পারে।

সারা পৃথিবী জুড়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং-এর গবেষকেরা ভবিষ্যৎকে পড়ে ফেলার চ্যালেঞ্জে সামিল হয়েছেন। কিন্তু ফুটবলের মতো খেলায় অনিশ্চয়তার যে নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, সেটাকে বাদ দিয়ে আগে থেকেই ম্যাচের ফলাফল আগাম মিলিয়ে দিলে তা বুকিদের লাভক্ষতির কাজে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের মন ভরাবে কি? অনিশ্চয়তার মধ্যেই হয়তো মানুষ সব থেকে বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করে। ভবিষ্যৎদ্রষ্টার ভূমিকায় সে স্বস্তি পাবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন