আপনার অভিমত

মহানগরী ভাসে আলোয়, কুপি জ্বেলে হাট বসে টোটোপাড়ায়

অতীতের কুসংস্কার পিছিয়ে দিয়েছে টোটো সম্প্রদায়কে। কিন্তু মন বদলাচ্ছে। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। লিখছেন পারমিতা ভট্টাচার্যঅতীতের কুসংস্কার পিছিয়ে দিয়েছে টোটো সম্প্রদায়কে। কিন্তু মন বদলাচ্ছে। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। লিখছেন পারমিতা ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৪
Share:

গ্রামের নাম টোটোদের নামে হলেও বর্তমানে এখানে টোটো সম্প্রদায় ছাড়াও নেপালি, ভুটানি, ধীমল ও রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন টোটোরা।

Advertisement

একদা শিকারই ছিল টোটো সম্প্রদায়ের জীবিকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে টোটোদের জীবিকায়। এখন ছোট ছোট জমিতে চাষ করেন এঁরা। ভুট্টা, কাওন জাতীয় দানাশস্য এবং কোয়াশ, নানা শাক-আনাজও চাষ করেন। নিজস্ব সংস্কৃতিতেই প্রকৃতির মধ্যে দিন কাটাতেই অভ্যস্ত এই সম্প্রদায়। তবে, আধুনিকতার ছোঁয়া সামান্য হলেও পৌঁছেছে অরণ্য-পর্বতের এই দুর্ভেদ্য জনপদের আনাচে-কানাচে। নতুন প্রজন্মের টোটোরা মান্ধাতার আমলের প্রচলিত নিয়মকানুন মানতে নারাজ। তাঁরা স্বাধীন ভাবে চলতে চান। চলছেনও। এবং কাজের তাগিদে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন প্রান্তে।

রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৯৫ সালে এখানে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, এত বছর ধরে টোটো সম্প্রাদায়ের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাটুকুও হয়নি! বর্তমানে বেশ কয়েকজন স্নাতক স্তর উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কাজকর্মে নিযুক্ত। এক সময় বিভিন্ন কুসংস্কার ছিল টোটোসমাজে। তাঁরা মনে করতেন, লেখাপড়া করলে মানুষ ক্ষণজীবী হয়। এই কুসংস্কারও স্কুলবিমুখ টোটোদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অবশ্যই সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরোত্তর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। তবে, খুশির কথা এটাই যে, জনবৃদ্ধির পাশাপাশি এখন সাক্ষরতার হারও বাড়ছে। পাল্টে যাচ্ছে টোটোদের চিন্তাভাবনাও। মেয়েদের মধ্যেও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছে। বর্তমানে টোটোপাড়া থেকে সত্যজিৎ টোটো সম্পাদিত ‘টোটবিকো লোইকো দেরেং’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটিতে টোটো ভাষায় টোটোদের মনের কথা বাংলা অনুবাদ-সহ প্রকাশ পায়। সেই সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদকীয় কলম পড়ে জানা গেল, টোটোদের যে ভাষা এবং সংস্কৃতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল, সেই পরম্পরাকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বেঁধে রাখার জন্যই এই পত্রিকা প্রকাশের চিন্তাভাবনা।

Advertisement

টোটো সম্প্রদায়ের না-পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা খানিক সামাল টোটোরা দিতে পেরেছেন নিজেদের চেষ্টায়। কিন্তু আজও বর্ষার দিনে হাউরি, বাংরি, তিতি নদীতে পাহাড়ি জলে ঢল নামে। নদীগুলির উপর সেতু না থাকায় বর্ষার দুর্যোগে টোটোরা বিচ্ছিন্ন থাকেন সংলগ্ন শহরাঞ্চল থেকে। ভোটের আগে আর্থসামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির একাধিক প্রতিশ্রুতির কথা শুনে আসছেন টোটোপাড়ার বাসিন্দারা। কিন্তু উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে! উন্নয়নের আঁচ তাঁদের কতটুকু ছুঁতে পেরেছে!

এই সব প্রশ্ন ঘুঘুডাকা নির্জন দুপুরের মতো ভাবনার মতো যখন খোঁচা দেয়, তখন পাহাড়ের বুকে চুল এলিয়ে বসেছে অস্তরাগ। নির্জনতা ভেদ করে ভেসে আসছে বিভিন্ন পাখির ঘরে ফেরার কূজন। জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঁকি দেয় আদিম নিশান এক টুকরো আঁধার। নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে ভুটান পাহাড়। চরম শূন্যতা শুকনো নদীখাতে। খড়িওঠা হাওয়া আচমকা বয়ে যায় কানের পাশ দিয়ে।

এই ছবির মধ্যেই দেখা যায়, ঘড়ঘড় শব্দে হেলতে দুলতে ধুলো উড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল দিনশেষের ট্রেকার। তাতে যাত্রী, মালপত্র, ছাগল, মুরগি— কী নেই! এক টুকরো কাপড়ে কোলের শিশুকে পিঠে বেঁধে জ্বালানি কাঠ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন টোটো রমণী। হাঁড়িয়া খেয়ে টলমল পায়ে বাড়ির কর্তাও ফিরছেন। টুং টুাং ঘন্টা দুলিয়ে চলেছে গরুর পাল। প্রতি রবিরার সন্ধেবেলা টিমটিমে কুপির আলোয় পসরা সাজিয়ে বসেছে টোটোপাড়ার সাপ্তাহিক হাট। ওই কুপির সলতে জানে না যে, মহানগরীর রাস্তা রোজ সন্ধ্যায় ভেসে যায় আলোর রোশনাইয়ে! (শেষ)

(লেখক ইসলামপুরের মণিভিটা হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন