জিল আব্রামসনের সদ্য-প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মার্চেন্টস অব ট্রুথ’
এক বিদেশি পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক জিল আব্রামসন তাঁহার সদ্য-প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মার্চেন্টস অব ট্রুথ’-এর জন্য বিতর্কের মুখে পড়িয়াছেন। অভিযোগ, তাঁহার গ্রন্থের বহু অনুচ্ছেদের সহিত পূর্বে প্রকাশিত কিছু গবেষণাপত্র ও সাময়িকীর বিস্ময়কর সাদৃশ্য। ইঙ্গিত স্পষ্ট, জিল ওই অনুচ্ছেদগুলি নিজে লিখেন নাই, অন্য লেখকদের লেখা হইতে টুকিয়াছেন। জিলের বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতা-ক্ষেত্রে চারটি বিখ্যাত সংবাদপ্রতিষ্ঠানের অবদান স্মরণ করিয়া লিখিত; তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছেন, উচ্চমানের সাংবাদিকতা যে কালে দুর্মূল্য ও দুর্লভ, যখন সাংবাদিকগণও দ্রুতির তাড়নায় তথ্য ও সত্যের যাথার্থ্য উপেক্ষা করিতেছেন, সে ক্ষণে এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকৃত সত্যের ফিরিওয়ালা হইয়া উঠিয়াছে। সৎ সাংবাদিকতা যে গ্রন্থের বিষয়, তাহার লেখক কী ভাবে অসদুপায় অবলম্বী হইলেন, প্রশ্ন তুলিয়াছেন সাংবাদিকগণ। জিল প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করিয়াছিলেন, পরে এক প্রকার দোষ স্বীকার করিয়াছেন। যদিও তিনি ইহাকে টোকাটুকি বলিতে নারাজ। তাঁহার মতে, গ্রন্থের শেষ ভাগে তিনি দীর্ঘ পাদটীকা যোগ করিয়াছেন, সেখানেই কোনও ভাবে ভুল হইয়া থাকিবে, বইয়ে উল্লিখিত কিছু মতামত ও তথ্যের উপযুক্ত উৎস নির্দেশ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয় নাই।
কোথায় সুদূর আমেরিকা, সেইখানে প্রকাশিত একটি বই লইয়া বিতর্ক-বিবাদে ভারতের কী, বলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেও স্বস্তির নিদ্রা আসিবে কি না বলা মুশকিল। তাহার কারণ ভারতেও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে একই জিনিস ঘটিতেছে, শুধু তাহাই নহে, উত্তরোত্তর সেই ধারা বিকট ও প্রকট হইয়া উঠিতেছে। দেশে সংবৎসর রাশি রাশি পিএইচ ডি উৎপন্ন হইতেছে, কিন্তু তাহাদের গুণ ও মান সম্বন্ধে নিঃসংশয় হইবার উপায় নাই। বরং এই বিপুল সংখ্যাই প্রমাণ— গবেষণা-সরিষার ভিতরে লুকাইয়া মধ্যমেধা ও গুণহীনতার ভূত। নিশ্চিত ভাবেই ইহা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ফল; সমগ্র প্রক্রিয়াটিই এমন হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে কিছু সময়, শ্রম, অর্থ এবং উপযুক্ত স্থানে আনুগত্য অর্পণ করিলে যথাসময়ে উচ্চতম ডিগ্রিটি হাতে চলিয়া আসা ব্যাপারবিশেষ নহে। এ হেন বন্দোবস্ত বহু শিক্ষার্থীকে অসৎ পথে প্ররোচিত করিয়া থাকে— অধিক শ্রমে কাজ কী, অমুক গ্রন্থ বা তমুক গবেষণাপত্র হইতে ওই ভাব বা সেই ভাষাটি তুলিয়া স্বরচিত বলিয়া চালাইলে কে আর দেখিতেছে?
এই সঙ্কট মোকাবিলায় ক্রমে বিপরীত প্রযুক্তি সহায় হইতেছে। গবেষণাক্ষেত্রে প্রচলিত আছে এমন সফটওয়্যারের ব্যবহার, যাহা কোনও গবেষণাপত্রে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ-বাক্য-ভাষা ছাঁকিয়া ‘সন্দেহজনক’ জায়গাগুলি তুলিয়া ধরিবে, শিক্ষার্থীকে সতর্ক করিয়া সেগুলির পরিবর্তন বা সংশোধনে বাধ্য করিবে। ভাষার চুরি না-হয় আটকানো সম্ভব হইল, কিন্তু চৌর্য প্রবণতার? তাহা গোকুলে বাড়িতেছে কি না, দেখিবে কে? ভারতীয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই দিকে মনোযোগ দিলে আশু মঙ্গল। নিত্যনূতন বহু সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাথা উঁচাইয়া দাঁড়াইতেছে, কাতারে কাতারে ছাত্রছাত্রী ও ভাবী গবেষক তথায় অপেক্ষমাণ। এই সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাষা ও ভাবের চুরির প্রবণতা রুখিতে উপযুক্ত প্রযুক্তি বা ব্যবস্থার প্রয়োগ হওয়া জরুরি। কে এই কাজ করিবেন, এখনও জানা নাই, কিন্তু করিতে যে হইবে তাহা বিলক্ষণ বুঝা যাইতেছে।