সর্বগামী সর্বনাশ

এভারেস্টের চূড়া হইতেও দশ টন আবর্জনা সাফ করা হইয়াছে এই বৎসর, আর সমুদ্রের তলে আনুমানিক পাঁচ ট্রিলিয়ন টুকরা প্লাস্টিক ভাসিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯ ০০:৩৬
Share:

বিশ্বের গভীরতম বিন্দুতে কী পাওয়া যাইবে? অতল শান্তি? গম্ভীর বোধি? সৃষ্টির আদিবীজ? পাওয়া যাইল, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ। এপ্রিলে, প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চ-এ প্রায় ৩৫,৮৪৯ ফুট নিম্নে প্লাস্টিকের ব্যাগ ভাসিতে দেখা যাইল। ইহা লইয়া, সমুদ্রের মনুষ্যগম্য গভীরতম অঞ্চলে, অন্তত তিন বার প্লাস্টিক মিলিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এই অঞ্চলে ৩৬,০০০ ফুট নীচে প্লাস্টিকের দোকান-থলি ভাসিতে দেখা গিয়াছিল, এখনও পর্যন্ত সেইটিই সর্বাধিক গভীরে ভ্রাম্যমাণ প্লাস্টিক হিসাবে রেকর্ড করিয়াছে, কিন্তু ব্রহ্মের ন্যায় অবিনাশী প্লাস্টিক হাসি হাসি পরাইতেছে ফাঁসি সমগ্র পৃথিবীর পরিবেশকে। এভারেস্টের চূড়া হইতেও দশ টন আবর্জনা সাফ করা হইয়াছে এই বৎসর, আর সমুদ্রের তলে আনুমানিক পাঁচ ট্রিলিয়ন টুকরা প্লাস্টিক ভাসিতেছে। কেবল পাড়ার নর্দমা রুদ্ধ করিয়া প্লাস্টিক থামিবে না, জীবনকেই অবরোধ করিবে, এই মর্মে মুহুর্মুহু সতর্কীকরণ সত্ত্বেও যখন মানুষের চৈতন্য ফিরিবার কোনও সম্ভাবনাই নাই, তখন এই সমুদ্র-আবিষ্কার এক ঝাঁকুনি দিয়া বুঝাইয়া দেয়, সর্বত্রগামী প্লাস্টিক সত্যই কোন গভীরে সেঁধাইয়াছে! সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ লইয়া ইতিমধ্যেই বহু সমীক্ষা হইয়াছে, অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরের অভ্যন্তরে প্লাস্টিকের অংশ পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে বাস্তুতন্ত্রের কী অবস্থা হইবে, নিরীহ প্রাণীগুলি কী কষ্টে মারা যাইবে, পরিবেশ কত দ্রুত উৎসন্নে যাইবে, মানুষ তাহার কুফল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কত বেদনায় ভুগিবে, তাহা লইয়া গবেষণা চলিবে। কিন্তু যাহা লইয়া মানুষ গর্বিত বোধ করিতে পারে, তাহা হইল তাহার সর্বনাশী ক্ষমতা।

Advertisement

মানুষ অগ্নি ও সঙ্গীত আবিষ্কার করিয়াছে, ভিন্ন গ্রহের অবস্থা জরিপ করিতে যান পাঠাইয়াছে, ব্যাঘ্রকে সার্কাসে ও চিড়িয়াখানায় সং সাজাইয়াছে। সে সমাজ গঠন করিয়াছে ও বহু মানুষকে সর্বহারা অবস্থায় উপনীত করিয়া ছাড়িয়াছে। সর্বোপরি, সে তাহার চতুষ্পার্শ্বে যাহা দেখিয়াছে, তাহারই ক্ষতিসাধন করিয়াছে। ইহাকে বলা যাইতে পারে ‘অ্যান্টি-মাইডাস’ স্পর্শ, গ্রিক পুরাণের মাইডাস নামক রাজা যাহা ছুঁইতেন তাহাই স্বর্ণ হইয়া যাইত, মানুষ যাহা ছোঁয় তাহাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, পুড়িয়া ঝুরিয়া ধ্বংসের শেষ প্রান্তে ধুঁকিতে থাকে। যে প্রকৃতি, যে পরিবেশ মানুষকে লালন করিয়াছে, মানুষ সর্বদা চমকপ্রদ কৃতঘ্নতার সহিত সেই পরিবেশের সামূহিক বিনষ্টির জোগাড় দেখিয়াছে। গাছ কাটিয়াছে, চিমনি ও যন্ত্র হইতে ক্রমাগত বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়িয়াছে, জীবনদায়ী নদীতে বিষাক্ত তরল ফেলিয়াছে, প্লাস্টিক ব্যাগে করিয়া দুই কেজি আলু লইয়া হাসিতে হাসিতে বাজার হইতে বাড়ি ফিরিয়াছে, সেই ব্যাগ তামাশা করিয়া পরে হাওয়ায় উড়াইয়া দিয়াছে। রাষ্ট্রের প্রধান বলিয়াছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন বলিয়া কিছু নাই, তাহা হইলে শীত পড়িতেছে কেমন করিয়া। মূর্খতা, ঔদ্ধত্য ও প্রায় অলৌকিক প্রযুক্তিগত উন্নতির সংমিশ্রণে এই প্রজাতিটি তাহার ধাত্রী গ্রহটিকে ধ্বস্ত নিকাশ করিতে বদ্ধপরিকর। মজা হইল, এই প্রলয়নাচন নাচিতে তাহার রুদ্ররূপ ধারণ করিতে হয় নাই, কেবল নির্বিকার অসচেতন অলসমস্তিষ্ক জীবন যাপনেই সে অনায়াসে ইহা সম্পন্ন করিয়াছে। অবশ্য কিছু মানুষ সচেতনতা জাগ্রত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন ও করিবেন। তাহাতে লাভ কিছু হইবে না, ব্যানারগুলি তাঁহারা প্লাস্টিকে লিখিবেন কি না, তাহাই কেবল আগ্রহের বিষয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন