সংস্কৃতির মেলবন্ধনে শেষ হয় বছর

এই উৎসবকে অনেকে বাংলার প্রকৃত গণ উৎসব বলে অভিহিত করেছেন। পুরনো বছরের যাবতীয় ক্লান্তিকে দূর করে নতুন বছরের আগমন বার্তা ঘোষণা এবং সমৃদ্ধি প্রার্থনাই এই উৎসবের মূল সুর। লিখছেন শান্তনু চট্টোপাধ্যায় ‘গাজন’ কথার উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একাধিক গবেষক মনে করেন ‘গা’ বা গ্রাম এবং ‘জন’ অর্থাৎ জনসাধারণ এই দু’টি শব্দের মেলবন্ধনে ‘গাজন’ শব্দের উৎপত্তি। তাঁদের মতে, ‘গাজন’ হল ‘গ্রামের জনসাধারণের উৎসব’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৬:৫৭
Share:

চড়কের প্রস্তুতি। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষ। তার আগে আজকে যাকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলা উদ্‌বেল হয়ে ওঠে তার নাম গাজন। এই উৎসব মূলত হাড়ি, বাগদি, বাউড়ি, ডোম, মুচি প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের উৎসব। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদগোপ প্রভৃতি শ্রেণিও এই উৎসবে সক্রিয় ভাবে যোগ দেয়। তাঁদের সম্মিলিত যোগদানে উৎসবটি গ্রামীণ বাংলার প্রকৃত লোক উৎসবের চেহারা নেয়। তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘হাওড়া জেলার লোক উৎসব’ গ্রন্থে এই উৎসবকে ‘বাংলার প্রকৃত গণ উৎসব’ বলে অভিহিত করেছেন। পুরনো বছরের যাবতীয় ক্লান্তিকে দূর করে নতুন বছরের আগমন বার্তা ঘোষণা এবং সমৃদ্ধি প্রার্থনাই এই উৎসবের মূল সুর।

Advertisement

‘গাজন’ কথার উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একাধিক গবেষক মনে করেন ‘গা’ বা গ্রাম এবং ‘জন’ অর্থাৎ জনসাধারণ এই দু’টি শব্দের মেলবন্ধনে ‘গাজন’ শব্দের উৎপত্তি। তাঁদের মতে, ‘গাজন’ হল ‘গ্রামের জনসাধারণের উৎসব’। অনেকে আবার ভিন্ন মত পোষণ করেন। গাজন উৎসবের দেবতা শিব বা মহাদেব। তিনি নন্দী, ভৃঙ্গী, বীরভদ্রদের নিয়ে শ্মশানে ঘুরে বেড়ান। কখনও কখনও জটার বাঁধন খুলে শিঙা বাজিয়ে নৃত্য করেন। মহামৌন কৈলাসের নীরবতা ভঙ্গ করতে জয়ধ্বনি দেন তাঁর অনুচরেরা। কালের কলতানে সেই জয়ধ্বনি পৌঁছে যায় ভক্তদের শিবপুজোর আঙিনায়। ভক্তদের জয়নাদে মুখর হয় গ্রাম বাংলা। সঙ্গে থাকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টার ধ্বনি। এ ভাবে নিস্তরঙ্গ গ্রামের বুকে গর্জন মুখর পরিবেশ তৈরি হয় বলেই এই উৎসবকে বলে ‘গাজন’। অর্থাৎ এই মতের সমর্থকদের কথা অনুসারে গাজন শব্দটির উদ্ভব গর্জন থেকে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই শিবের গাজন হয়। তবে সব জায়গায় একই দিনে হয় না। পূর্ব বর্ধমান-সহ বেশিরভাগ জেলায় বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র ৩০ বা ৩১ দিনের হলে যথাক্রমে ২৭ বা ২৮ তারিখ থেকে গাজন শুরু হয়ে থাকে। প্রথম দিন হয় ‘কামা’ অর্থাৎ স্বেচ্ছায় বা মানত করে কয়েক জন পুরুষ বা নারী নাপিতের কাছে ক্ষৌরকার্য সেরে গঙ্গা বা যে কোনও নদীতে স্নান সারেন। যে শিবমন্দিরে তাঁদের মানত সেখানকার পুরোহিত তাদের গলায় উত্তরীয় বা একগোছা সুতো পরিয়ে দেন। এ ভাবে তাঁরা গাজনের ভক্ত বা সন্ন্যাসী হন। গাজন উপলক্ষে তাঁরা কয়েক দিনের জন্য দেব সেবার অধিকার লাভ করেন। এই সময় গাজনের সন্ন্যাসীরা নিজেদের কাছে একগাছা বেতের লাঠি রাখেন। এবং নানা আচার পালন করেন। গেরুয়া লাল কাপড় পরে সন্ধ্যায় হবিষ্যান্ন খান। কাজ অনুসারে এই ভক্ত বা সন্ন্যাসীদের ‘মূল সন্ন্যাসী’, ‘দেউলে পাত্র’, ‘ভোগডাকা’, ‘পাটভক্তা’, প্রভৃতি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে অবশ্য মূল সন্ন্যাসী ছাড়া অন্য ভাগগুলি বিশেষ দেখা যায় না। অভিজ্ঞ বা বয়স্ক ব্যক্তি মূল সন্ন্যাসীর দায়িত্ব পান। শাস্ত্রীয় পুজো এবং হোম, যজ্ঞ বাদে দেবতার সব কাজই তিনি করতে পারেন।

Advertisement

প্রথম রাতে হয় বোলান। এটি বাংলা লোক সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। বিভিন্ন স্থানে নানা রকমের বোলান দল তাদের গান ও নাচ, পরিবেশন করে শিবমন্দির সংলগ্ন আসরে। শ্মশান দলও দেখা যায়। তারা ভূত প্রেত সেজে বিভিন্ন ভাবে শিবের গীত গায়। নানা রকম বিষয় বিশেষ করে সমকালীন সময় রাজনীতি সমাজকে কেন্দ্র করে গান বাঁধা হয়ে থাকে। বাজার চলতি অথবা জনপ্রিয় বাংলা ও হিন্দি গানের সুরে সেই গানগুলি বাঁধা হয়ে থাকে। দু’টি দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাওয়া হয় বলে এগুলিকে ‘দাঁড়া’ নামে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়াও সাঁওতালি দল, ভাটিয়ালি দল, বিভিন্ন রকমের বাজনার সঙ্গে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করে। কাটোয়া মহকুমার সুদহর গ্রামের রণপা নাচের দল রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সারা রাত ধরে এমনকি, তার পরের দিন সকাল দশটা বা বারোটা পর্যন্ত চলে এই বোলান গান। গ্রাম্য বিবাদ, জমি, সম্পত্তি ও রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গ্রামের মানুষ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান।

দ্বিতীয় দিনে হয় জল সন্ন্যাস। বোলানের শেষে শিব মূর্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে ভক্ত সন্ন্যাসীরা মাথায় করে গঙ্গা বা নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যায়। শ্মশান দলও তাদের সঙ্গী হয়। বহু গ্রামের প্রথা অনুসারে শিব স্নান সেরে গ্রামে না ফেরা পর্যন্ত কোনও বাড়িতে রান্না চড়ে না। রাতে শিবপুজোর পরে ‘বাণ ফোড়া’ হয় সন্ন্যাসীদের কপালে পিঠে ও জিভে।

তৃতীয় দিন নীলপুজো। নীলকণ্ঠ শিব লক্ষ্মী পুজো আয়োজিত হয় বিভিন্ন বাড়িতে। মহিলারা শিবের মাথায় জল দিয়ে পরিবারের মঙ্গল প্রার্থনা করেন। অনেক জায়গায় এ দিন সন্ধ্যায় হোম আয়োজিত হয়।

চতুর্থ বা সংক্রান্তির দিন ভোরে হয় ফুল খেলা। শুকনো আইড়ি গাছ, পাট কাঠি, আখের ছিবড়ে জ্বেলে আগুন ধরানো হয়। সেই আগুনের শিখার মধ্যে দিয়ে সন্ন্যাসীরা ছোটাছুটি করেন। আগুন নিভলে তাঁরা ওই অঙ্গারে গড়াগড়ি দেন।

এ দিন বিকেলে আয়োজিত হয় চড়ক অনুষ্ঠান। বিশেষ ধরনের একটা গাছের কাণ্ডকে সারা বছর কোনও জলাশয়ে ডুবিয়ে রেখে ওই দিন বাজনা সহকারে জয়ধ্বনি দিয়ে তোলা হয় জল থেকে। তার পরে পুজো করে তাকে পুঁতে দিয়ে তার উপরে চক্র বেঁধে দড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়। মানতকারী সন্ন্যাসীর পিঠে বঁড়শি দিয়ে গেঁথে ঘোরানো হয়। যদিও এই প্রথা ১৮৬৩ সালের আইন অনুসারে নিষিদ্ধ। তবে এখনও গ্রাম গঞ্জে এটি প্রচলিত রয়েছে। চড়ক উপলক্ষে বহু জায়গায় মেলা বসে। অনেকে সেই মেলায় সং সেজে যোগ দেন।

পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিনে ওই মন্দিরে পুরোহিত সন্ন্যাসীদের উত্তরীয় নামিয়ে দেন। নিম্নবর্ণের মানুষেরা তাঁদের দেব কার্যের অধিকার হারান। চড়ক গাছে ঘুরে এক নতুন বছর আসে। নতুন করে জীবন শুরুর প্রার্থনা নিয়ে শেষ হয় আর্য অনার্য সংস্কৃতির মিলনে তৈরি হওয়া এই উৎসব।

কাটোয়ার গৃহশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন