ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা

পান্তাভাত, লোকগীতি, ধুতি-শাড়ি ও গীতিনাট্যের ট্র্যাডিশন সমানে চলিবে জানিয়া, এবং তাহাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাইয়া, বঙ্গসমাজ ও তাহার সাংস্কৃতিক কীর্তিকলাপের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টিপাত করিলে সংশয় থাকে না যে, বর্তমান বাঙালির ঝুলিতে সকলই প্রবীণ, সকলই মলিন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৩
Share:

নানা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে, বর্ণ ও শ্রেণিস্বার্থবুদ্ধির প্রেরণায় সমাজদেহ যখন ভিতর হইতে ক্রমশ পঙ্গু ও দুর্বল হইয়া পড়ে, তখন ভিতরে ভিতরে জড়ের জঞ্জাল এবং মৃতের আবর্জনা ধীরে ধীরে জমিতে জমিতে পুঞ্জ পুঞ্জ স্তূপে পরিণত হয়... সমাজদেহে তখন ভিতর-বাহিরের কোনো আঘাতই সহ্য করিবার মতন শক্তি ও বীর্য থাকে না, প্রত্যাঘাত তো দূরের কথা।— ১৯৪৯ সালের ১৫ অগস্ট বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব গ্রন্থের উপসংহারে লিখিয়াছিলেন নীহাররঞ্জন রায়। তাহার পরে প্রায় সাত দশক অতিক্রান্ত। কিন্তু ১৪২৬ বঙ্গাব্দে পৌঁছাইয়া পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাসবিদের কথাগুলি অতি প্রাসঙ্গিক ঠেকিতেছে। প্রশ্ন উঠিতে পারে নববর্ষের শুভলগ্নে নববস্ত্র পরিধান করিয়া বাঙালি খাবার, বঙ্গভাষা ও বঙ্গীয় সংস্কৃতির স্নিগ্ধরসে সিঞ্চিত হওয়াই স্নিগ্ধতনু বঙ্গজনের কর্তব্য, এই পুণ্যপ্রভাতে আবার পুঞ্জীভূত জড়ের জঞ্জাল ও মৃতের আবর্জনার প্রসঙ্গ কেন! কিন্তু, সত্য সে যে সুকঠিন। নূতন বৎসরের সূচনায় যদি তাহাকে স্বীকার করিবার সৎসাহস সমাজের না থাকে, তবে তো বুঝিতে হইবে, সেই সমাজ কেবল দুর্বল নহে, বিগতপ্রাণ। সমাজের জীবনীশক্তি যদি কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে আপন গ্লানিময় অস্তিত্বের কলঙ্করাশিকে সারহীন সাংস্কৃতিক অভিমানের আড়ালে লুকাইবার করুণ প্রয়াস ছাড়িয়া ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনাগুলি নির্মম সততায় বিশ্বজগতের সম্মুখে পুড়াইবার কাজটি তাহার কর্তব্য। নববর্ষ আত্মসমীক্ষার লগ্ন। আত্মশুদ্ধিরও।

Advertisement

পান্তাভাত, লোকগীতি, ধুতি-শাড়ি ও গীতিনাট্যের ট্র্যাডিশন সমানে চলিবে জানিয়া, এবং তাহাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাইয়া, বঙ্গসমাজ ও তাহার সাংস্কৃতিক কীর্তিকলাপের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টিপাত করিলে সংশয় থাকে না যে, বর্তমান বাঙালির ঝুলিতে সকলই প্রবীণ, সকলই মলিন। ইতস্তত নূতন যদি কিছু থাকে, তাহা নিছক ব্যতিক্রম। সংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রেই এই সমাজ নিজস্ব নূতন ভাবনার সাহস ও আগ্রহ হারাইয়া বহুলাংশে বিজাতীয় আক্রমণের সম্মুখে আত্মসমর্পণ করিয়াছে এবং সেই কারণেই রবীন্দ্রজয়ন্তী বা সরস্বতী পূজার মতোই পয়লা বৈশাখেও তাহার নিজস্ব কোনও নূতন সৃষ্টি উপহার দিবার নাই, অতএব ক্যালেন্ডারের পাতায় এমন উপলক্ষ হাজির হইলেই সে পাভলভীয় প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চর্বিতচর্বণে আত্মনিয়োগ করে। যে সাহিত্যসংস্কৃতি লইয়া আজও তাহার অহঙ্কারের শেষ নাই, সেখানে নূতন সৃষ্টিপ্রতিভার স্ফুরণ স্তিমিত হইতে হইতে অন্তর্ধানের পথে।

এই ক্ষয় এক দিনের নহে। গত শতাব্দীতেই ইহার সূত্রপাত। ইহার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলি বহুআলোচিত। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কেবল সমাজমানসের এক বিশেষ পরিবর্তনের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। উনিশ শতকের মধ্যভাগ হইতে অন্তত এক শতাব্দী ধরিয়া বঙ্গসংস্কৃতির যে উজ্জ্বল অধ্যায়, তাহার এক প্রধান চরিত্রলক্ষণ ছিল চেতনার আন্তর্জাতিকতা। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বকবি অভিধাটি নির্বোধ বহুব্যবহারে জীর্ণ ও বর্জ্য, কিন্তু ইহা অনস্বীকার্য যে, ওই অভিধা যে বাঙালি ভাবিতে পারিত, তাহার মস্তিষ্কের অভিমুখ ছিল ৩৬০ ডিগ্রি প্রসারিত। বিশ্বের চিন্তাভাবনাকে সে সাগ্রহে স্বীকার করিতে চাহিয়াছিল। স্বীকৃতির অর্থ আত্মসমর্পণ নহে— বাহিরের চিন্তাকে আপন যুক্তি ও বাস্তবতার কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া, প্রায়শই তাহার সহিত প্রবল তর্ক করিয়া সে আপন চেতনার নবায়ন ঘটাইয়াছিল। এই আন্তর্জাতিকতা হইতে সমাজ বহুলাংশে বিচ্যুত। বিশ্বপৃথিবী সম্পর্কে তাহার আগ্রহ মুখ্যত বিবিধ বিনোদনের উপভোক্তা হিসাবে, চিন্তাভাবনায় সে আপন কূপের বাহিরে যাইতে নারাজ। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া পাইবার অঙ্গীকার যে জাতিকে চালনা করিত, সে এখন আত্মপ্রদক্ষিণেই সন্তুষ্ট। বৃহৎ বাঙালি একমনে ক্ষুদ্র বাঙালি হইবার সাধনা করিয়া চলিতেছে। পান্তাভাতেই তাহার সিদ্ধিলাভ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন