পুলিশের ন্যায় গুন্ডা ভারতে নাই, বলিয়াছিল ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বের কথাটি স্মরণ করাইল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। পুলিশি নির্যাতনের শিকার এক তরুণ দম্পতি কেন ক্ষতিপূরণ পাইবেন না, উত্তরপ্রদেশ সরকারের তাহার জবাব দাবি করিয়াছে কমিশন। সোমবার কমিশনের নিকট উত্তরপ্রদেশের পুলিশ তিরস্কৃত হইবার অনতিপূর্বে চণ্ডীগড়ে এমনই দুর্বৃত্তসুলভ আচরণ করিয়াছে হরিয়ানার পুলিশ। নববর্ষের প্রাক্কালে রোহতক লেকের ধারে যুগলদের হয়রান করিতেছে তিন পুলিশের একটি দল, সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করিয়াছেন এক আইনজীবী। কোন সরকারি নির্দেশ, কোন আইনের ভিত্তিতে পুলিশ তরুণতরুণীদের জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছে, তাহাদের ফোন নম্বর তলব করিতেছে, তরুণীর পরিবারের সহিত কথা বলিবার দাবি করিতেছে, আইনজীবীর এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাই পুলিশ। সোশ্যাল মিডিয়াতে পুলিশের এই হয়রানির ছবি প্রকাশিত হইলে শোরগোল পড়িয়াছে। যুগলদের পুলিশি হয়রানি বন্ধ করিতে জনস্বার্থ মামলা হইবে, এমনও প্রস্তাব উঠিয়াছে। অনেকেই প্রস্তাবে সহমত হইবেন, কারণ তরুণ বয়সে এমন অভিজ্ঞতা কাহার হয়নি? উদ্যান প্রভৃতি জনস্থানে, এমনকী নির্জন রাস্তায় হাঁটিলেও যুগলকে হয়রান, অপমান করিয়া টাকা আদায়, রাজি না হইলে থানায় আনিয়া ধমকধামক, মিথ্যা মামলায় ফাঁসাইবার হুমকি, পুলিশের এই দুর্ব্যবহারের শিকার হইতেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক তরুণতরুণী একত্র সময় কাটাইলে তাহাদের বিরুদ্ধে তর্জনী তুলিবার অধিকার পুলিশের নাই। তাহারা স্বেচ্ছায় একত্র বাস করিলে, পরিবারের মতের বিরুদ্ধে বিবাহ করিলেও কিছু করিবার ক্ষমতা নাই পুলিশের। বরং তাহাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই পুলিশের কাজ।
কিন্তু পুলিশ বরাবর পুরুষতন্ত্রের প্রহরীর ভূমিকাটি লইয়াছে। বাড়ির অমতে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণতরুণী বিবাহ করিলেও অপহরণ, ধর্ষণ প্রভৃতি অভিযোগ দায়ের করিয়া তাহাদের নাজেহাল করিতে থাকে পুলিশ। উত্তরপ্রদেশের বলরামপুরের যে ঘটনায় পুলিশ মানবাধিকার কমিশনের নিকট ভর্ৎসিত হইল, সেটিতে তরুণ ও তরুণীকে হাজতে বন্দি করার এবং তরুণীর শ্লীলতাহানিরও অভিযোগ উঠিয়াছে পুলিশের বিরুদ্ধে। রাজ্যবাসীর মনে থাকিবে, রিজওয়ানুর রহমানের অপমৃত্যুর ঘটনাতেও পুলিশের প্রতি একই ভাবে আইনভঙ্গ এবং অমানবিকতার অভিযোগ উঠিয়াছিল। এমন দৃষ্টান্ত অজস্র। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েটির বক্তব্যকে, বিশেষত তাহার সম্মতিকে সম্পূর্ণ উড়াইয়া দিয়া পুলিশ পরিবারের জেঠামহাশয়ের ভূমিকাটি লইয়া থাকে। আইন এড়াইয়া, মানবিকতা ভুলিয়া, কেবল উর্দির জোর দেখাইয়া উৎকোচ আদায়, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় ফাঁসাইবার অভিযোগ কম নাই পুলিশের বিরুদ্ধে।
তিক্ত সত্য ইহাই যে, পুলিশের এমন অপকর্মের প্রতি সমর্থনও রহিয়াছে সমাজের। এক নাগরিক অপরকে মারিলে-ধরিলে, জোর করিয়া অবরুদ্ধ করিলে শাস্তি হইবে। তুলনায় পুলিশকে হাত করিয়া অন্যায় মারধর, আটকাইয়া রাখা ‘বৈধ’ করিবার ঝুঁকি কম। সম্প্রতি নানা চলচ্চিত্রে, টিভি চ্যানেলে অপরাধ ও তাহার কিনারা বিষয়ে যে সকল কাহিনি জনপ্রিয় হইয়াছে, সেখানে অপরাধী সন্দেহে ধৃত ব্যক্তিদের যারপরনাই প্রহার করিবার দৃশ্য পুলিশের তদন্তের অনুসঙ্গ বলিয়া প্রদর্শিত হয়। এমনকী অভিযুক্তকে নির্বিচারে হত্যাও করিয়া থাকেন নায়ক-পুলিশরা, তাহাতে করতালির বন্যা বহিয়া যায়। অর্থাৎ পুলিশের আইনলঙ্ঘনকে সমাজও ‘অপরাধ’ বলিয়া দেখিতে অভ্যস্ত নহে। পুলিশের অপরাধ কম নহে। কিন্তু যাহারা পুলিশকে উর্দি-পরা গুন্ডাবাহনী করিয়া রাখিতে চাহে?