রাজনীতি নয়, চাই আনুগত্য

সম্প্রতি সেনাপ্রধান বিপিন রাবত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিত ভাবে লোক ঢোকাচ্ছে পাকিস্তান।

Advertisement

পলাশ পাল

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০
Share:

প্রথম ভারতীয় কম্যান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল কে এম কারিয়াপ্পাকে সাবধান করে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ‘নট টু প্লে দ্য রোল অব সেমি-পলিটিক্যাল লিডার।’ সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক পরিকল্পনায় নাক গলাচ্ছিলেন তিনি। এক জন পেশাদার সৈনিকের রাজনৈতিক বিষয়ে এহেন কৌতূহলকে স্বাভাবিক ভাবেই বরদাস্ত করতে পারেননি নেহরু। ১৯৫৩ সালে বিদায়ী ভাষণে সতীর্থদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নয়, নির্বাচিত সরকারের প্রতি আনুগত্যই সেনাবাহিনীর একমাত্র কর্তব্য।’

Advertisement

সম্প্রতি সেনাপ্রধান বিপিন রাবত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিত ভাবে লোক ঢোকাচ্ছে পাকিস্তান। চিনের মদতে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসাবে ভারতের ওই এলাকাকে অস্থির করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। অসমে বদরুদ্দিন আজমের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট-এর দ্রুত প্রভাব বাড়ার পিছনেও রয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় বিপিন রাবতের উদ্দেশ্য শুভ, তিনি ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যটির নিরাপত্তা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত, তবু এক জন সর্বোচ্চ পদের সেনা আধিকারিক প্রকাশ্য সভায় রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন এবং সরকারও তাতে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে বিষয়টিকে এক রকম মান্যতা দিয়েছে, বিস্মিত হতে হয় বইকি। এটা শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিত ও এক্তিয়ার-বর্হিভূতই নয়, গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনকও বটে।

দুর্ভাগ্য, জেনারেল রাবত এমন এক সময়ে এই অভিযোগ করেছেন যখন অসমে নাগরিক নিবন্ধকরণের কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ের খসড়া তালিকায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ লোককে নাগরিক হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হলেও তালিকার বাইরে রয়ে গিয়েছেন আরও ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। এঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী বা তাঁদের বংশধর বলে অভিযোগ। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রহীন অ-নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর সরকার ইতিমধ্যেই পার্লামেন্টে একটি আইন পাশ করেছে, লক্ষ্য, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। রাবতের বক্তব্য সেই আগুনে ঘি নিক্ষেপের সামিল। ১৯৮০-র দশকে অসম জুড়ে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলনের পরিণতি তাঁর ভুলে যাওয়ার কথা নয়।

Advertisement

রাজনীতিতে কোনও দল দ্রুত গতিতে বাড়ার নানা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এই উত্থানপতনের পিছনে রয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশ, এমন ধারণায় অতি-সরলীকরণের সঙ্গে পক্ষপাতও আছে। অসমের গত তিনটি বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস, বিজেপি, এআইইউডিএফ বা অসম গণ-পরিষদ, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির আসন ও প্রাপ্ত ভোটের হার ওঠানামা করেছে। এক সময়ের প্রভাবশালী দল অসম গণ-পরিষদের জনপ্রিয়তা কমে এখন মাত্র ৮ শতাংশ। অন্য দিকে বিজেপি ও এআইইউডিপি-র জনসমর্থন সমানেই বেড়েছে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে এই দুটি দলের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল যথাক্রমে ৯ ও ৯ শতাংশ। ২০১৬-য় তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ ও ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলির উত্থান-পতনের নেপথ্যে অভিবাসনের থেকে নিজ নিজ দলের কার্যক্রমের ভূমিকাই বেশি।

জেনারেল রাবতের বিতর্কিত মন্তব্য এটাই প্রথম নয়। এর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে তিনি শিরোনামে এসেছেন। গত জানুয়ািরতে জম্মু ও কাশ্মীরের শিক্ষানীতির সমালোচনা করে বলেছিলেন, ওই রাজ্যের সরকারি স্কুলের পাঠ্যক্রম বিপজ্জনক। বলেছিলেন, মানচিত্র দুটি। একটি ‘জম্মু ও কাশ্মীর’-এর, অন্যটি ‘ভারতের’। ২০১৭-য় কাশ্মীরের সব আন্দোলনকারীকে সন্ত্রাসবাদী বলে বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন। নাগরিক আন্দোলন ও জঙ্গিদের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে এক করে দেখার ফলটা ভাল হয়নি।

পৃথিবীর কোনও দেশের সেনাবাহিনীই পুরোপুরি নীরব নয়। রাজনীতির বাইরের জগতের মানুষ হলেও তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামত থাকে। তবে একটু সংযত হয়ে চলতে হয়। বিপিন রাবত কিন্তু সেনাপ্রধান হয়েও যেন রাজনৈতিক বিবৃতি দিচ্ছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যা নিতান্তই বেমানান। এই বিবৃতির পালা যদি লাগামহীন ভাবে চলতেই থাকে এবং সরকারের ভূমিকাটা হয় নীরব দর্শকের, তাতে বিপদের আশঙ্কা প্রচুর, সেনা আধিকারিকদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়।

আমাদের জাতীয় জীবনে সেনা-জওয়ানদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ নিয়ে এক ধরনের সম্ভ্রম রয়েছে। তাঁরা প্রতিকূল পরিবেশে জীবন বাজি রেখে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেন, আর এই কারণেই তাঁদের কথাবার্তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে অনেক বেশি। রাজনীতিকরাও এর সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিক উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ ও গুজরাতের নির্বাচনে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছিল রাজনৈতিক প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইতিহাস বার বার প্রমাণ করেছে, রাজনৈতিক ভাষ্যে এক বার সামরিকীকরণ ঘটলে তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। সেনা জেনারেলদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের ক্ষুধা জেগে উঠলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও অত্যন্ত দুরূহ। পাকিস্তান ও মায়ানমার উদাহরণ। রাবতকে ঠিকমত শাসন করা সরকারের অবশ্যকর্তব্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন