সম্পাদকীয় ১

রাজনীতির কল

বাপু-সংসর্গে উদ্ভাসিত যে রাজনীতিকদের ভিডিয়ো ক্লিপিং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হইতেছে, তাঁহাদের মধ্যে কেহ বাপুকে বুঝাইয়া বলিতে পারেন, ধর্ম নহে, সে মারা পড়িল রাজনীতির হাতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০০:৩৭
Share:

এক যাত্রা না হইলেও এক অভিমুখে তো বটে। রাম রহিম ইনসানেরও ধর্ষণের দায়ে জেল হইয়াছিল। আসুমল সিরুমালানা হরপালানি, ওরফে আসারাম বাপুরও একই অপরাধে একই শাস্তি হইল। কারাগারে বসিয়া বাপু ভাবিতে পারে, রাম রহিমের জন্য যদি দাঙ্গা বাধিয়া যাইতে পারে, দিল্লি-হরিয়ানা অচল হইয়া যাইতে পারে, আমার জন্যই বা নহে কেন? এই পৃথক ফলের হেতু কী? তবে কি আমার ক্ষেত্রে ধর্মের কল খানিক বেশি জোরে নড়িয়া উঠিল? নচেৎ, আসারামেরও প্রতিপত্তি নেহাত কম ছিল না। সাবরমতীর তীরে সামান্য আশ্রম হইতে দশ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য সেও গড়িয়াছিল। দেশ-বিদেশে চার শতের অধিক আশ্রম ছিল তাহারও। তাহার দরবারেও রাজনীতিকদের ভিড় কম ছিল না। গুজরাতে কংগ্রেস সরকার তাহাকে আশ্রম গড়িতে সাড়ে তিন একর জমি দিলে বিজেপি সরকার দিয়াছিল আরও ছয় একর। স্বয়ং হিন্দুহৃদয়সম্রাট নরেন্দ্র মোদী তাঁহার আশ্রম পরিদর্শনে গিয়াছিলেন। জানাইয়াছিলেন, যখন আর কেহ ছিল না, তখন তাঁহার পার্শ্বে ছিলেন আসারাম। অর্থাৎ, রাম রহিম আর আসারামে তেমন ফারাক ছিল না। তাহার ভক্তরাও অতীতে একাধিক বার মারমুখী হইয়াছে। অথচ, বাপুকে যখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ শুনিতে হইতেছে, তখন ভক্তিসাগরে একটি ঢেউও উঠিল না।

Advertisement

বাপু-সংসর্গে উদ্ভাসিত যে রাজনীতিকদের ভিডিয়ো ক্লিপিং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হইতেছে, তাঁহাদের মধ্যে কেহ বাপুকে বুঝাইয়া বলিতে পারেন, ধর্ম নহে, সে মারা পড়িল রাজনীতির হাতে। নাবালিকা ধর্ষণের প্রশ্নে ভারত এখন উত্তাল। শত চেষ্টাতেও কাঠুয়ার আট বৎসর বয়সি মেয়েটির মৃত্যুর দায় ঝাড়িতে পারিতেছেন না প্রধানমন্ত্রী। রাতারাতি অধ্যাদেশ জারি করিয়া নাবালিকা ধর্ষণে ফাঁসির বন্দোবস্ত হইয়াছে। আসারামের বিরুদ্ধে যে নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ, সে তফসিলি জাতিভুক্তও বটে। অর্থাৎ, আসারাম বাপুর পা যেখানে কাটিয়াছে, ঠিক সেখানেই বিজেপির দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দুশ্চিন্তা আসিয়া মিশে। জিগ্নেশ মেবাণীদের সময়ে দাঁড়াইয়া এক তফসিলি জাতিভুক্ত নাবালিকার ধর্ষকের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন প্রকাশ যে রাজনৈতিক আত্মহত্যারও বাড়া, এই কথাটি সম্ভবত দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের প্রতিটি ইট জানে। বস্তুত, কোনও রাজনৈতিক দলই আসারামের পার্শ্বে দাঁড়াইবার ভুল করিবে কি? ফলে, রাম রহিমের শাস্তিতে যে ভঙ্গিতে গোটা উত্তর ভারত কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, আসারামের সাজায় সাবরমতীর জলে তাহার কোনও প্রতিফলনই হইল না।

জনতার রোষ, স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ইত্যাদি কথা ভারতীয় রাজনীতিতে বহুলপ্রচলিত। আসারামের নিস্তরঙ্গ জেলযাত্রা দেখিতে দেখিতে কেহ ভাবিতে পারেন, কথাগুলির মধ্যে কয় আনা সত্য রহিয়াছে? রাম রহিমের সমর্থকরা আগুন জ্বালাইলে আসারামের ভক্তরা শান্ত থাকিল কেন? দ্বিতীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষিত, বিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই। রাজনীতির সমীকরণ ভাবিবার দায়ও তাহাদের নাই। ফলে, পড়িয়া থাকে একটিই সম্ভাবনা— পূর্বের বিক্ষোভটিও ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ছিল না। তাহা সুকৌশলে নির্মিত হইয়াছিল। কারণ, রাম রহিমকে কেন্দ্র করিয়া অশান্তি পাকাইয়া তুলিতে পারিলে যে রাজনৈতিক লাভ আছে, তাহা নেতাদের নজর এড়ায় নাই। এই দফায় বিক্ষোভের অভাব, কারণও সেই রাজনীতির হিসাব। যাঁহারা বিক্ষোভ নির্মাণ করেন, তাঁহারা আঁক কষিয়া দেখিয়াছেন, এই দফায় ক্ষতির পাল্লা ভারী হইবে। শুধু এই দুইটি ক্ষেত্রই নহে, কোথাওই কোনও বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্ত হয় কি না, ভাবিয়া দেখা ভাল। রাজনীতির গতিবিধি বুঝিতে সুবিধা হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন