প্রবন্ধ

কমেডি ফাঁস করে দেয় রাজনীতির কারসাজি

শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন ‘টুয়েলফ্থ নাইট’। ব্রাত্য বসুর পুনর্লিখন ‘মুম্বাই নাইট্স’। রঙ্গমঞ্চ কী ভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় অন্তর্ঘাত করতে পারে, চার শতাব্দীর ব্যবধানেও সেটা খেয়াল না করে উপায় নেই।শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন ‘টুয়েলফ্থ নাইট’। ব্রাত্য বসুর পুনর্লিখন ‘মুম্বাই নাইট্স’। রঙ্গমঞ্চ কী ভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় অন্তর্ঘাত করতে পারে, চার শতাব্দীর ব্যবধানেও সেটা খেয়াল না করে উপায় নেই।

Advertisement

স্বপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০০:২৯
Share:

টুয়েলফ্‌থ নাইট’ নাটকটি সম্ভবত ১৬০১ সালে লেখা। ওই বছর বড়দিনের পর দ্বাদশ রজনীতে, অর্থাৎ এপিফ্যানি-র রাতে, যে তারিখে তিন প্রাজ্ঞ পুরুষ সদ্যোজাত ত্রাতাকে দেখতে বেথলেহেমে তীর্থ করতে আসেন, রানি এলিজাবেথ হোয়াইটহল প্রাসাদে অর্সিনো নামের এক ইতালীয় অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। রাজসভার আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ ছিল শেক্সপিয়ারের দল ‘লর্ড চেম্বারলেন্‌স’ প্রযোজিত এক নাটক। অভ্যাগতদের নামের সঙ্গে ‘টুয়েলফ্‌থ নাইট’ নাটকের এক প্রধান চরিত্রের নামের মিল রয়েছে— সে আবার ডিউক, তার সামাজিক কদর গল্পে সব চাইতে বেশি। তা ছাড়া নাটকের নামের ব্যাখ্যা গল্পে নেই, হয়তো মঞ্চায়নের উপলক্ষের মধ্যে রয়েছে। ৬ জানুয়ারির ধার্মিক তাৎপর্য গুরুগম্ভীর, কিন্তু তার উদ্‌যাপনের ধরনটি উৎসবের, অন্তত বেশ কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে।

Advertisement

আইনের পড়ুয়া জন ম্যানিংহ্যাম-এর রোজনামচা থেকে জানতে পাই যে, তাঁর আইনের ইসকুল মিডল টেম্পল-এ নাটকটি তিনি দেখেন ১৬০২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ও-দিনও আবার গির্জার পাঁজিতে পরবের দিন। সে-দিন ক্যান্ডলমাস উপলক্ষে মোমবাতি জ্বালানো হয়, কারণ ওই তারিখে যিশুর জন্মের চল্লিশ দিনের মাথায় জেরুজালেমের মন্দিরে পুরোহিতদের কাছে তাঁকে হাজির করেন তাঁর মা।

নাটকটির সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক তাই সব দিক থেকেই নিবিড়। রাজসভায় অভিনীত নাটকে রাজনীতির প্রসঙ্গও সংলাপে দুর্লভ নয়। শেক্সপিয়ার এই দু’টি মাত্রাকে আলাদা করে রাখেননি, কমেডি ও ট্র্যাজিক সম্ভাবনাও মূল নাটকে প্রায়শই একাকার। সামাজিক বিভাজন একটি ছিল গল্পে। উপরতলার প্রেম-প্রতিহিংসার বৃত্ত আভিজাত্য ও কাব্যিক সংলাপে প্রকাশ, আর নিচুতলার দুনিয়ায় সেই একই প্রসঙ্গগুলি হুল্লোড় এবং অভব্য গদ্যের আবহে ঘেরা।

Advertisement

‘মুম্বাই নাইট্স’ নামের পুনর্লিখনে নাট্যকার ব্রাত্য বসু বিন্যাসটি ধরেছেন নিপুণ ভাবে। মিনার্ভা রেপর্টরি থিয়েটার প্রযোজিত নাটকটিতে রাজনীতি, প্রেম ও হিংসার বিকল্প পটভূমি হল মুম্বই চলচ্চিত্রের জগৎ এবং তার সঙ্গে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাজশ। কমিক হুল্লোড় জমিয়ে তোলার খাতিরে শেক্সপিয়ার ইতালীয় কোম্মেদিয়া দেল্লার্তে-র খড়ের কাঠামোর উপরে লাগিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য ধারালো সংলাপ ও চরিত্রায়ণের প্রলেপ। ব্রাত্যর নাটকে জমাটি মজার আশ্রয় মুম্বই ফিল্মে মনোরঞ্জনের রকমারি মশলার ঝাঁঝালো মিশেল। সামাজিক বিভাজনটি বাংলা নাটকটিতেও ঠিক দৃঢ় নয়। এই দুই মহলের মধ্যে সেতুর কাজ করেছে পারিবারিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার রফা, এবং সূত্রধর-সদৃশ একটি গাইড চরিত্র।

‘মুম্বাই নাইট্স’ বাংলা থিয়েটারে শেক্সপিয়ার-চর্চায় এক নতুন খবর। শেক্সপিয়ারের নাটকে যে লৌকিক-লোকোত্তরের সন্ধি, গদ্য ও কাব্যের যে রৌদ্ররাত্রির খেলা, তার সঙ্গে টক্কর দূরস্থান, অনুকৃতির চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হননি ব্রাত্য। তিনি কাজে লাগিয়েছেন ব্রেখ্‌ট-এর ‘মজা’। প্রমোদ-ব্যবসার সঙ্গে যখন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের যোগ প্রায় ওতপ্রোত, তখন সেই ‘মজা’ আর স্রেফ হিন্দি ছবির গান, সম্মেলক নাচ, মঞ্চসজ্জা, কোরিয়োগ্রাফি ও কোরাস-সদৃশ ব্যান্ডের ব্যবহারের অজুহাতে সীমিত থাকে না। তামাশার ছলে সাম্প্রদায়িকতা বা যুদ্ধবাজ রাজনীতির প্রসঙ্গ তাই কোনও সময়েই আরোপিত বলে মনে হয় না।

ইংরেজি নাটকটির কথা উঠলেই ভাষ্যকাররা একটি শব্দ ব্যবহার করেন: মেলানকলি— বিষাদ। জুডি ডেন্চ এক দশকের বেশি ফারাকে ভায়োলা-র ভূমিকায় অভিনয় করেন বিলেতে, ১৯৫৭ সালে ওল্ড ভিক প্রযোজনায়, আবার ১৯৬৯ সালে জন বার্টন-এর নির্দেশনায় রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানির হয়ে। তিনি লিখেছেন, প্রথম বার মঞ্চসজ্জা ও পোশাকের প্রধান রং ছিল হেমন্তের, বাদামি ও হালকা লাল, দ্বিতীয়বার বসন্তের সবুজ ছিল বেশি। নাটকের সময়কাল শীত হলেও প্রেমের বিচিত্র প্রমাদ হেমন্তের কুয়াশাজনিত বলে ভ্রম মনে হতে পারে, আবার বসন্তের স্বপ্ন বলেও হাজির করা যায়। প্রতীচ্যের শিল্পে প্রেমের এই মায়ার খেলা— যার মধ্যে সমকামিতার ইঙ্গিতও মিশে আছে— প্রায়শ কৌতুক ও উল্লাসের ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে, যেমন মোৎসার্টের ‘ফিগারোর বিবাহ’ অপেরায়।

এই মিশেলের তাৎপর্য মোক্ষম ধরেছেন ব্রাত্য বসু। শেক্সপিয়ারের প্রতিভায় বিষাদ ও কৌতুক, সূক্ষ্মতম কাব্য ও স্থূলতম হুল্লোড়, প্রেম ও হিংস্রতা সামাজিক জীবনের মৌলিক উপাদান— এদের পৃথক করলে জীবন, সমাজ ও রাজনীতি বিমূর্ত বিষয় হয়ে পড়ে। মুম্বইয়ের রাস্তায় জনস্রোত, গণেশ চতুর্থীর শোভাযাত্রা, ক্রিকেট, অপরাধ জগৎ, বিনোদন ব্যবসা এবং মৌলবাদী রাজনীতি তেমনই এক সূত্রে গাঁথা বাংলা ভাষ্যটিতে। পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের রাজনীতির কারসাজি কী ভাবে ফাঁস করে দিতে পারে কমেডি, সেই পাঠটি ব্রাত্য বসু নিয়েছেন ইংরেজ নাট্যকারের থেকেই।

শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর পরেই ১৬২৩ সালে ‘টুয়েলফ্‌থ নাইট অর হোয়াট ইউ উইল’ নাটক নামের হেঁয়ালি ছেড়ে ‘মালভোলিয়ো’ নামে মঞ্চস্থ হয়। মালভোলিয়ো ধনী অলিভিয়ার ঘরদোরের নিয়মরক্ষী, বেনিয়মের কড়া শত্রু। এর এক দশকের মধ্যেই ইংল্যান্ডের দোরগোড়ায় গৃহযুদ্ধ। ক্রমশ রাজতন্ত্রবিরোধীদের নেতৃত্ব চলে যায় মালভোলিয়োদের হাতে, ১৬৪২ সালে হুল্লোড়ের দুশমনরা দেশের সব থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে দেয়। আমাদের দেশেও কি তুলনীয় পরিস্থিতি আসন্ন? রঙ্গমঞ্চের অন্তর্ঘাতী সম্ভাবনাটি অন্তত ভুলতে দেন না নাট্যকার-নির্দেশক। কমেডির প্রাণকেন্দ্রে হাসি ও নিষ্ঠুরতার যে সমবায়, তা অসামান্য অভিনয়ে টানটান ধরে রাখেন মালভোলিয়ো চরিত্রে (রূপান্তরিত নামে) গৌতম হালদার।

কিছুটা আর্থিক মদত ও মেধাবী নির্দেশনা পেলে আমাদের নবীন মঞ্চাভিনেতারা কী করে দেখাতে পারেন, ‘মুম্বাই নাইট্স’ তার উজ্জ্বল নমুনা। নাচ, গান, মঞ্চভাবনা, পোশাক, শারীরিক কসরত— নানা দিকে এত দক্ষ এত জন শিল্পীর সমাবেশ একমাত্র পাশ্চাত্যের মিউজিকাল এবং আমাদের বাণিজ্যিক ছবিতে দেখা যায়। যেহেতু প্রযোজনার নেপথ্যে রয়েছে সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের দাক্ষিণ্য, সেহেতু রাজকোষের সমর্থন কোন পথে বাংলা পেশাদার থিয়েটারকে খানিক স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে, সেই চিন্তাও উসকে দেয় এই ব্যতিক্রমী নাটক।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন