Netaji Subhas Chandra Bose

স্বপ্নদর্শী

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র ‘সেরা দেশপ্রেমিক’, বলিয়া গিয়াছেন মহাত্মা গাঁধী। বলিয়াছেন, সুভাষ একাই দেশকে শিখাইয়াছেন, কী ভাবে ‘শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আত্মত্যাগ ও ঐক্য’ তৈরি করিতে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৩৬
Share:

বা‌ংলার বাহিরে বাঙালি সম্পর্কে যে সব তির্যক সমালোচনা কিংবা ব্যঙ্গ-পরিহাস চলে, তাহার মধ্যে একটি হইল, বাঙালি কেবলই তাহার ঊনবিংশ-বিংশ শতকের কৃতী মানুষদের গর্বে আত্মহারা, স্বপ্নে বিভোর। তাহারা রবীন্দ্রনাথকে কয়েকটি গানের মধ্যে নামাইয়া একটি খাটো-কৃত প্রতিকৃতিতে পর্যবসিত করে, রামমোহন-বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দ-সুভাষচন্দ্রকে স্মরণের নামে সঙ্কীর্ণ সংস্কৃতি-অবগাহনে মাতিয়া থাকে, প্রফুল্লচন্দ্র-জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানীকে রাস্তার নামে বাঁধাইয়া নিজেরা তুচ্ছতার সাধনা করে। সব মিলাইয়া, বাঙালির কাছে কর্মযোগ ধর্মযোগ সকলই তুচ্ছ, নামযোগই সব। ইত্যাকার সমালোচনা কিয়দংশে সঙ্গত, কিন্তু বহুলাংশে সারহীন। এবং সেই অংশের গুরুত্ব কিন্তু একেবারে উড়াইয়া দিবার মতো নহে। বর্তমানে যখন সমগ্র ভারত সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে দ্রুতবেগে নিমজ্জমান, তখনও যে বাংলাকে জয় করিতে সেই রাজনীতির এতখানি বেগ ও অতখানি দুশ্চিন্তা— ইহাই প্রমাণ করে বাংলার ঐতিহ্যের ওই ‘অংশ’টুকুর জোর। বাঙালি এখনও নিজেদের মনীষীদের বলিয়া-যাওয়া কথা ও করিয়া-যাওয়া কাজের সূত্রে আপনার ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নটুকুতেই তাহার জোর। সংস্কৃতিতে অবগাহন যতই তাচ্ছিল্যকর হউক, সেই সূত্রে অন্তত মানবতাবাদের কিছু উচ্চারণ বাঙালির কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। নেতাজি যে বাঙালির মনোভূমিতে আজও লীন, তাহা কেবল বাঙালির মানসিক ব্যাধি নহে, ‘বৃহৎ’-এর প্রতি প্রণতির সম্মেলক বাসনাও বটে। নেতাজি সুভাষ অসম্ভবকে সম্ভব করিতে চাহিয়াছিলেন, জীবন তুচ্ছ করিয়া স্বাধীনতা চাহিয়াছিলেন। তাঁহার তুলনীয় স্বপ্নদর্শী নেতা পরাধীন বা স্বাধীন ভারতে খুঁজিয়া পাওয়া ভার। এই স্বপ্নের গৌরবে যদি বাঙালি ভর করিতে চাহে, তাহাকে লইয়া ব্যঙ্গ করা চলে না।

Advertisement

মুশকিল বাধে যখন এই স্বপ্নের ‘অংশ’টি বাহির হইতে কেহ না বুঝিয়াও বুঝিবার ভান করেন। বাঙালির মানসে ঠিক কোথায় নেতাজির স্থান, সেই সন্ধান না পাইয়া ভিত্তিহীন মাতামাতি শুরু করেন। নেতাজির ১২৪তম জন্মবার্ষিকীর আগে আকস্মিক হইচই তাই পীড়াদায়ক। প্রধানমন্ত্রী মোদী ভোটের তাগিদে নেতাজিকে স্মরণ করিতে গিয়া ভুলিয়া যাইতেছেন যে, কলিকাতা বন্দরের নাম তাঁহারা শ্যামাপ্রসাদ রাখিয়াছেন যখন ডকের নামে আছেন নেতাজি, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাইয়া নেতাজিকে জওহরলাল নেহরুর ‘শত্রু’ হিসাবে তুলিয়া ধরিয়াছেন। তাঁহারা ইতিহাস জানেন না। নেতাজির জন্মদিনকে ‘পরাক্রম দিবস’ নাম দিতে চাহিয়াছেন, কেননা তাঁহারা ঘোড়ায়-চড়া নেতাজিকে শুধু পরাক্রমশালী যোদ্ধা ভাবেন, দেশের ঐক্যস্বপ্নে বিভোর দেশপ্রেমিক ভাবেন না। ‘পরাক্রম’ শব্দটি হিন্দিতে সুমধুর হইলেও বাংলায় কিন্তু তাহার দ্যোতনা নেতিবাচক। তাঁহারা বাংলা ভাষা জানেন না।

বস্তুত তেইশ জানুয়ারির জন্য ‘দেশপ্রেম দিবস’ নামই উপযুক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র ‘সেরা দেশপ্রেমিক’, বলিয়া গিয়াছেন স্বয়ং মহাত্মা গাঁধী। বলিয়াছেন, সুভাষ একাই দেশকে শিখাইয়াছেন, কী ভাবে ‘শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আত্মত্যাগ ও ঐক্য’ তৈরি করিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শুনিতেছেন কি? নেতাজিকে শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ‘ঐক্য’ ছাড়া কোনও কিছু দিয়াই সম্মান দান করা যাইবে না। কোনও মাল্যদান বা বাণী-বিতরণেই নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন