ত্রিপুরায় ঘোর তোড়জোড়। মোদী ম্যাজিক দেখাইবার তোড়জোড়। গত কয়েকটি প্রাদেশিক নির্বাচন বুঝাইয়া দিয়াছে, বিজেপির দেশব্যাপী অশ্বমেধ যজ্ঞ কার্যক্রমের মধ্যে প্রধান— মোদী ম্যাজিক। তাঁহার একক মুখ এই কার্যক্রমের কেন্দ্রে। তাঁহার মুখচ্ছবি গোটা রাজ্যে ছড়াইয়া যায়, তাঁহার মুখনিঃসৃত বচন রাজ্যময় শোভা পায়। তিনি একাই তাঁহার দলের ভাবমূর্তি, এবং তাঁহার দলের অ্যাজেন্ডা। এই ম্যাজিক তৈয়ারি করিবার একটি বিশিষ্ট পন্থা, প্রতিপক্ষের উদ্দেশে ব্যক্তিগত আক্রমণ। তিনি নিজে অকুস্থলে উপস্থিত হইয়া এই আক্রমণের উৎসমুখ খুলিয়া দেন। আর তাহাতে উল্লাসে মাতোয়ারা হইয়া ওঠে তাঁহার গোটা দল। সম্প্রতি ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘মানিক বদলাইয়া হিরা আনিবার’ উদাত্ত আহ্বান শুনিয়া ঠিক এই উল্লাসই ছড়াইয়া গেল সে রাজ্যের বিজেপি কর্মীদের মধ্যে। ইতিমধ্যেই তাঁহারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে সর্বশক্তিসহকারে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন উত্তর-পূর্বের এই অ-বিজেপি ঘাঁটিটিকে ‘কবজা’ করিবার লক্ষ্যে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান তাঁহাদের শক্তিমত্ততা কয়েক গুণ বাড়াইয়া দিয়াছে। এই ভোকাল টনিক কেন দরকার ছিল, তাহা পরিষ্কার। হাজার হউক, গত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তত ভাল নয়। গুজরাতে জয় আসিয়াছে সামান্য ব্যবধানে। আর রাজস্থানের উপনির্বাচনে আসিয়াছে পরাজয়। বামফ্রন্ট শাসিত এই রাজ্যটির গৈরিকীকরণের যজ্ঞে তাই কোনও ঝুঁকি লওয়া যাইতেছে না।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভোকাল টনিক অনেক দিন চালু। তবে মোদীর প্রযুক্তিটি আলাদা ধরনের। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি তাঁহার রুচিবহির্ভূত কুবচন শুনিয়া তাঁহার দল আন্তরিক প্রফুল্লতা লাভ করে, সেই প্রফুল্লতা হইতে সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের স্পিরিট নির্গত হয়। আরও একটি কারণে কুবচন জরুরি, কেননা সোজাসুজি রাজনৈতিক ভাষায় প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করিবার মতো রসদ অনেক সময়ই তাঁহার দলের ভাণ্ডারে থাকে না। চার বৎসরে রাজনীতির অঙ্গনে বলিবার মতো কৃতিত্বগুলি ঠিক কী, কোনটিকে নির্বাচনী প্রচারে যথেষ্ট ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে তাঁহার দলীয় নেতৃত্বও নিশ্চিত নহে। তাই অপরকে লইয়া হাসিঠাট্টা, রঙ্গরসিকতাই ভরসা। আর সেই রসিকতা ব্যক্তিগত হইলে তাহার স্বাদ আরও বেশি।
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, সম্ভবত বিজেপির এই খেলাটি বুঝিয়াই, ফাঁদে পা দেন নাই। ত্রিপুরার মানুষ হিরা চাহে না মানিক চাহে, এই নিতান্ত অসার রসিকতার জবাবে সংক্ষেপে বলিয়া দিয়াছেন যে, ত্রিপুরার মানুষ জানেন ইহার উত্তর। ইহাও বলিয়াছেন যে প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের পদের গুরুত্ব না রাখিতে পারেন, এমন কথা বলেন, সে বিষয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই, মুখ্যমন্ত্রী উবাচ। এত গুরুত্বপূর্ণ কথাটি প্রধানমন্ত্রীর কানে প্রবেশ করিল কি? তিনি কি বুঝিতেছেন, বাগ্মী হইলেই রাজনীতিক হওয়া যায় না, রাজনীতিক হইবার জন্য রাজনৈতিক লড়াই করিতে জানিতে হয়। দেশের দুর্ভাগ্য, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসনের দৌলতে রাজনীতি বস্তুটিই এখন মানুষ ক্রমে বিস্মৃত হইতে বসিয়াছেন। অথচ কে তাহাদের মনে করাইবে যে, অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর, অপভাষা ও অপসংস্কৃতি দিয়া রাজনীতির শূন্য স্থান পূরণ করা যায় না।