১৯৭০-এর দশকে ইলি নাসতাসে ছিলেন এক বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় এবং তাঁহার নাম লইয়া একটি জনপ্রিয় বাংলা রসিকতা প্রচলিত ছিল। ছেলে বাবাকে নাসতাসের ছবি দেখাইয়া বলিতেছে, বাবা এই দেখো নাসতাসে। বাবা বলিতেছেন, নাসতাসে কোথায়, এ তো হাসতাসে! বাঙাল ভাষায় এই চুটকিটি কিঞ্চিৎ বিপদে পড়িল, কারণ এই মুহূর্তে নাসতাসে হাসিতেছেন না। চির কালই তিনি কোর্টে নানাবিধ মশকরা করিয়াছেন, সুপুরুষ হিসাবেও পরিচিত ছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড় ও রেফারির সহিত ঝগড়াঝাঁটিও করিয়াছেন বিস্তর, সব মিলাইয়া তাঁহার জনপ্রিয়তা ছিল প্রবল। তাঁহার জীবনীতে ফাঁপাইয়া জাহির করা হইয়াছে, কত মহিলাকে শয্যাসঙ্গিনী করিয়াছেন। এখন রোমানিয়ার মহিলা টেনিস দলের ‘ক্যাপ্টেন’ হইয়া, সত্তর বৎসর বয়সে গত সপ্তাহে তিনি হুলস্থূল বাধাইলেন। ম্যাচ চলাকালীন দর্শকদের চিৎকারে বিরক্ত হইয়া ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় প্রতিবাদ করিতে গেলে, নাসতাসে গালাগালি দিয়া চেঁচাইতে থাকেন এই মর্মে, ইহা তো অপেরা নহে, দর্শক চুপ থাকিবে কেন। ইহার পর ওই খেলোয়াড় ও ওই দলের কোচ, এবং রেফারিকে গাল পাড়িতে থাকেন। তাঁহাকে সতর্ক করা হয়, শেষে কোর্ট হইতে বহিষ্কার করা হয়। ইহা ব্যতীত, ওই টুর্নামেন্টেরই প্রেস কনফারেন্সে শুনা যায়, সেরেনা উইলিয়ামসের ভাবী সন্তান সম্পর্কে তিনি বলিতেছেন, দেখা যাক উহার কী রঙ হয়, চকলেটের সহিত দুধ? সেরেনা কৃষ্ণাঙ্গ, তাঁহার প্রেমিক শ্বেতাঙ্গ, তাই এ হেন মন্তব্য। পরের দিন প্রেস কনফারেন্সে নাসতাসে এক রিপোর্টারকে সম্মুখে পাইয়া তিরস্কার করিতে থাকেন। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন যে তেত্রিশ বৎসর বয়সি নারী, তাঁহাকে নাসতাসে বহু বার হোটেলের রুম নম্বর জিজ্ঞাসা করিয়াছেন অশ্লীল ইঙ্গিত করিয়া। এক প্রাক্তন খেলোয়াড় বলিয়াছেন নাসতাসে তাঁহার সহিত দেখা হইলেই জিজ্ঞাসা করিতেন, তিনি কুমারী কি না। ইহা অন্তত ত্রিশ বার ঘটিয়াছিল।
পৃথিবী নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়া চলিলেও, ইদানীং রাজনৈতিক ঠিকতা এক বিরাট শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং বহু বিখ্যাত মানুষের বিরুদ্ধেই দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়াছে। এক সময় কেহ কোনও ক্ষেত্রে বিশাল হইলে, তাঁহার টুকরা-অন্যায়কে বরং গ্ল্যামারের অঙ্গ ধরা হইত, মেয়েদের সম্পর্কে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলা ছিল খ্যাতনামা পুরুষের যাপনের এক চিত্তাকর্ষক দিক। তাহার পর ক্রমে পৃথিবী সচেতনতা অভ্যাস করিয়াছে, এমনকী রোমান পোলানস্কির ন্যায় বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারও বহু দিন পূর্বের যৌন নিগ্রহের ঘটনায় এখনও নিস্তার পান নাই। ইহার মূলে রহিয়াছে নারীবাদীদের দীর্ঘকালীন অনবরত আন্দোলন ও আধুনিক প্রযুক্তির ফলে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নামে এক অত্যাশ্চর্য গণতান্ত্রিক পরিসরের উত্থান, যেখানে যে কোনও ঘটনা জনতার দরবারে উপস্থিত করা যায় প্রায় ঘটিবার সঙ্গে সঙ্গেই, এবং জনতা সেই বিষয়ে মত জানাইতে পারে কোনও বাধার পরোয়া না করিয়াই, ভীতিহীন ভাবে। ইনস্টাগ্রাম-এ সেরেনা উইলিয়ামস নাসতাসের মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, ফেসবুকে টুইটারেও যে ভাবে জনমত সংগঠিত হইতেছে, তিনি নিষ্কৃতি পাইবেন বলিয়া মনে হয় না।
তবে, মন্তব্যগুলি বর্ণবৈষম্য বা লিঙ্গবৈষম্যের দিকে না ঝুঁকিলে, এত হইহই হইত কি না, বলা কঠিন। খেলা চলাকালীন বিশ্রী গালির প্রচলন বহু খেলায় বহু কাল ধরিয়া রহিয়াছে। বাংলার ফুটবল ম্যাচে এক সময় গালাগালির বন্যা বইয়া যাইত। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি লইয়া ফিল্ডাররা মন্তব্য করেন এবং ইহা এখন ‘স্লেজিং’ বলিয়া খেলার অংশ হিসাবেই স্বীকৃত। বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালে জিদান প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়কে প্রবল ঢুঁসো মারেন, কারণ সেই খেলোয়াড় তাঁহার মাতাকে লইয়া বিশ্রী কথা বলিয়াছিলেন। এই সকলই খেলায় ঘটিবে বলিয়াই ধরিয়া লওয়া হয় কারণ খেলার সময় মানুষ প্রবল উত্তেজিত থাকে। যদিও টেনিসে শিষ্টাচার ও আদবকায়দার বাঁধন কিছু দৃঢ়, নাসতাসে বলিতে পারেন, তিনিও উত্তেজনার বশে অধিকাংশ কথা বলিয়া ফেলিয়াছেন। তাহাতেও চিঁড়া না ভিজিলে বলিতে পারেন, রাজনীতিতে যদি বৃহৎ পদাধিকারীরা সকল দায়িত্ব ভুলিয়া ক্রমাগত কুরুচিকর ও অশিক্ষিত মন্তব্য করিতে পারেন, তবে খেলোয়াড় বলিয়া তিনি পিছাইয়া থাকিবেন কেন? অথবা কাঁদিয়া মার্জনা চাহিতে পারেন, বৃদ্ধের রোদনে যদি কর্তৃপক্ষ নরম হইয়া পড়েন। আর কিছু না হউক, বাংলায় রসিকতা-বাক্যের বিবর্তন ঘটিবে: নাসতাসে কোথায়, এ তো কাঁদতাসে!
যৎকিঞ্চিৎ
যাঁরা কেকেআর-এর হয়ে খেলেন সাধারণত, কেউই কলকাতার নন, বাংলারও নন। তাতে কলকাতার লোকের প্রকাণ্ড সমর্থনে একটুও ভাটা পড়ে না, গম্ভীর উথাপ্পা নারাইনকে কলকাত্তাইয়া ভাবতে কণামাত্র অসুবিধে হয় না, দলটার নামে কলকাতা-টুকু থাকলেই, ‘আমাদের’ টিম। তা হলে বুঝিয়েসুঝিয়ে ব্রাজিলের নাম কলকাতা আর ফেডেরারের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় করে দিলে কেমন হয়? কোর্টে অ্যাফিডেভিট করাতে যা টাকা লাগবে, রাজ্য সরকার দিয়ে দেবে’খন!