তবু আলোচনার বিকল্প নেই

প্রশাসনের এক সহজাত প্রবৃত্তি হল, ভাল মন্দ যে কোনও কাজই ফতোয়া দিয়ে শুরু করা। আর যে সরকার প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি অবলম্বন করে এগোয়, তার মধ্যে প্রকল্পের নিদান এবং তার ভিত্তিতে আদেশ দিয়ে এগিয়ে চলার প্রবণতা আরও বেশি জন্মায়।

Advertisement

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৭ ১৪:০০
Share:

অগ্নিগর্ভ: রাজ্য সরকারের নীতির বিরুদ্ধে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কর্মীদের প্রতিবাদ মিছিল। দার্জিলিং, ১৮ জুন ২০১৭। ছবি: পিটিআই

দার্জিলিঙের পাহাড়ে যে আগুন জ্বলেছে, তা হয়তো এক দিন নিভে যাবে। প্রশাসন যাদের বিরোধী দুষ্টচক্র বলে ভেবেছে, হয়তো তারাও এক দিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এ-সব হবে কোন মূল্যে? পাহাড়ে অশান্তি আপাতত থামলেও, যে ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং ক্রোধ এই অশান্তি থেকে আবার জন্ম নেবে অথবা আরও গভীর হবে, তাকে প্রশাসন সামলাবে কী করে? বিভেদ এবং পার্থক্য আরও গভীর হলে শুধু প্রশাসনের ক্ষতি নয়, বাংলার ক্ষতি। হয়তো এক অর্থে অপূরণীয়।

Advertisement

কিন্তু এ পরিণতি কি অমোঘ ছিল? ইতিমধ্যেই প্রাণহানি হয়েছে। বামফ্রন্টের জমানায় জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে আন্দোলন চলাকালীন যে প্রাণহানি হয়েছিল, হিংসা-প্রতিহিংসার অন্তহীন আবর্তে তা যে আবার হবে না, কে বলতে পারে? এই বিক্ষোভে দু’পক্ষকেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু প্রথম পদক্ষেপের তাগিদ এবং কর্তব্য প্রশাসনেরই, কারণ তারা রাজ্যের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে।

প্রশাসনের এক সহজাত প্রবৃত্তি হল, ভাল মন্দ যে কোনও কাজই ফতোয়া দিয়ে শুরু করা। আর যে সরকার প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি অবলম্বন করে এগোয়, তার মধ্যে প্রকল্পের নিদান এবং তার ভিত্তিতে আদেশ দিয়ে এগিয়ে চলার প্রবণতা আরও বেশি জন্মায়। এই পদ্ধতিতে কিছু ভাল কাজ হয়, কিন্তু আলোচনার অভ্যেস কমে যায়।

Advertisement

প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্কুল-শিক্ষায় বাংলা ভাষা চালু করার নির্দেশ এল এই রকমই এক ফতোয়া জারির পদ্ধতিতে। উদ্দেশ্য সাধু। কিন্তু সরকারের চিন্তায় কেন এল না, ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার সংরক্ষিত হবে কী ভাবে? এটা শুধু নেপালিভাষীদের বিষয়ে প্রশ্ন নয়, ধরুন জঙ্গলমহলের সাঁওতালিভাষীদেরও প্রশ্ন। সাঁওতালি ভাষা শেখানো আদিবাসী সম্প্রদায়ের বহু দিনের দাবি। তেমনই, অন্য সংখ্যালঘু ভাষাও আছে। কোথায় ঐচ্ছিক হবে, কতগুলো ভাষা বিদ্যালয়ে শেখানো হবে, এ নিয়ে শিক্ষা সংক্রান্ত মানুষজন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করলে ক্ষতি হত না, বরং লাভ হত।

সরকার দার্জিলিং পাহাড়ে অন্যান্য জনজাতিদের স্বায়ত্তশাসিত বিকাশ পরিষদ গড়েছে, ভাল কথা। কিন্তু তাদের সঙ্গেই বা আগে আলোচনা হল না কেন? পরিস্থিতির পিছনে যে অবিমৃশ্যকারিতা, তার দায়ভাগ প্রশাসন অস্বীকার করতে পারে না।

ফতোয়া জারি করে কাজ করার পদ্ধতি ইদানীং প্রশাসনের অন্য কর্মসূচিতেও দেখা গেছে। ভাঙড়, ভাবাদিঘি, এই দু’ক্ষেত্রেই সরকারি নির্দেশ, দমন, এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর চেয়ে। প্রশাসন কি জানে না, কেন ভাঙড়ে জনসাধারণ শাসক দলের আঞ্চলিক নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ? এর জন্য কেন জনসাধারণকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে হবে? জনবিক্ষোভের কথা জেনে কেন প্রশাসন সেখানে আলোচনায় বসবে না?

মুখ্যমন্ত্রী জেলা স্তরে প্রশাসনিক বৈঠকের যে ধারা সৃষ্টি করেছেন, তা প্রশংসনীয়। এতে কাজের উদ্যোগ বেড়েছে, প্রশাসন শক্তিলাভও করেছে। কিন্তু এই বৈঠক যদি দরবারে পরিণত হয়, এখান থেকে যদি নীতিগত সিদ্ধান্ত জারি হতে থাকে ব্যাপক পরামর্শ ছাড়াই, যদি এই বৈঠকে দলীয় সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়, তবে এর প্রকৃত মূল্য কমে যাবে। সম্রাট অশ্বারূঢ় হয়ে আসেন, ভাষণ দেন, চলে যান, পরিস্থিতি একই থেকে যায়। বরং সম্রাটের আগমনকে ঘিরে উপদলীয় কলহ বাড়তে থাকে।

কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল বন্ধ করার আকস্মিক ফতোয়ার কথাও ধরা যায়। বহু দিনের রাজনৈতিক স্মৃতি কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে যুক্ত, সে বিষয়ে আগাম কথাবার্তা বললে ক্ষতি হত না। মীমাংসাসূত্র বেরোতে পারত। হয়তো সপ্তাহে দু’দিন মিছিল সমাবেশ সংগঠিত করার রীতি জারি হত, বলা যেত যে, দুপুর দুটো বা তিনটের পরে সমাবেশ, মিছিল হতে পারে— এতে পড়াশোনাও চলতে পারত, কলেজ স্ট্রিট কলেজ স্ট্রিটও থাকত। এ সবই সম্ভব যদি প্রশাসনে যুক্ত হয় সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে শলাপরামর্শের রীতি এবং সংস্কৃতি।

এই সরকার জনপ্রিয়তাবাদী। তারা ২০১১ থেকে বেশ কিছু ভাল কাজ করেছে, জনকল্যাণকামী উদ্যোগগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সরকারের পাথেয় রূপে প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কিন্তু কুবেরের ধন শেষ হতে সময় লাগে না। ইচ্ছাতন্ত্র এবং আলাপবিমুখতা সরকারের গ্রহণযোগ্যতার ভাঁড়ার দ্রুত শেষ করে দিতে পারে।

দার্জিলিঙে উগ্রতা সামলাতে প্রশাসনকে দৃঢ় থাকতে হবে, ঠিকই। কিন্তু এই সামলানোরই আবশ্যিক অঙ্গ হল আলোচনা, যাতে পার্বত্যাঞ্চলে মধ্যপন্থী মানুষও নানা সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির পক্ষে পথে নামতে পারেন। প্রশাসনের মূল সমস্যা: বিরোধীদের কী ভাবে আলোচনায় বসতে রাজি করানো যাবে? প্রশাসনকে ভেবে বার করতে হবে, কী ভাবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, যাতে সংঘাতের তীব্রতা কমে আসে, আলোচনা সহজ হয়, বিরোধীদের পক্ষে আলোচনা না-করতে চাওয়াই শক্ত হয়ে ওঠে। অবশ্যই, কিছু পূর্বশর্ত থাকবে। প্রশাসন কি শর্ত দেবে যে, আগে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে হবে? নাকি মোর্চা বলবে, পুলিশ বাহিনী, বিশেষত কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা হোক? সরকারকে কয়েক জন মধ্যস্থতাকারীও খুঁজে বের করতে হবে, যাঁরা হয়তো এখন পাহাড়ে বিরোধী শিবিরেই যোগ দিয়েছেন।

প্রশাসন যদি ভাবে, আরও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই অচলাবস্থা থেকে বেরনো যাবে, মস্ত ভুল করবে। জ্যোতি বসুর সরকার গত শতকের আশির দশকে প্রচুর আধা-সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়ে পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলেছিল। তার পর থেকে সেখানে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমতেই থাকে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার আপাতত আধা-সামরিক বাহিনী, সেনাবাহিনী ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বটে, কিন্তু তা আবার ভবিষ্যতে এই সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল করে ফেলতে পারে। তার যে রাজনৈতিক মূল্য চোকাতে হবে, সেটা কম নয়।

বিরোধীদের আগ্রাসী অবস্থানের মোকাবিলা করতে হলে, সরকারকে পাহাড়ে তৈরি করা নিজেদের রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমনকী শিলিগুড়িতেও সাধারণ মানুষ পাহাড়ে শান্তির দাবিতে জড়ো হচ্ছেন না। শান্তি আনতে গেলে প্রথমে ছাড়তে হবে প্রশাসনিক পদ্ধতি আর পুলিশ নামানোর ওপর জোর দেওয়ার মনোভাব, সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিক সংগঠন দিয়ে। সরকার এই দুটো পদক্ষেপ থেকেই বিরত থাকছে আর আশা করছে, সবচেয়ে খারাপ সময়টা তারা পেরিয়ে এসেছে।

হয়তো সবচেয়ে খারাপ পর্যায়টা সত্যিই কেটে গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কী শিক্ষা আমরা এই বিক্ষোভ থেকে পেলাম, আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ: সরকার কী শিখল? পপুলিজম বা জনপ্রিয়তাবাদ কিছু কিছু সময়ে ভাল, কিন্তু তা যখন নিজেকে বাড়াতে বাড়াতে পরিণত হয় চালাকি আর অদূরদর্শিতায়, তখন তার গুরুত্ব কমে আসে। এই সময়ে সমাজের চিড় ও ফাটলগুলো নিষ্ঠুর ভাবে উন্মোচিত হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন