সম্পাদকীয় ১

দায়িত্বহীন ক্ষমতা

সিভিক পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক কাহাকে বলে? যাহারা পুলিশ নহে, কিন্তু পুলিশও, তাহারাই সিভিক পুলিশ। তাহারা স্বভাবে অশিষ্ট, দাপটে উর্দিধারীদের চতুর্গুণ এবং রাজনৈতিক আনুগত্যে নির্ভুল, তাহারাই সিভিক পুলিশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৭ ০০:৪০
Share:

সিভিক পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক কাহাকে বলে? যাহারা পুলিশ নহে, কিন্তু পুলিশও, তাহারাই সিভিক পুলিশ। তাহারা স্বভাবে অশিষ্ট, দাপটে উর্দিধারীদের চতুর্গুণ এবং রাজনৈতিক আনুগত্যে নির্ভুল, তাহারাই সিভিক পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের অলি-গলি-রাজপথে তাহাদের উপস্থিতি সর্বময়। তাহারা পুলিশ নহে, কারণ সরকারি খাতায় তাহাদের নাম নাই। তাহাদের চাকুরিতে ঢুকিবার জন্য কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না, স্থানীয় স্তরেই তাহাদের নিয়োগ হইয়া থাকে। যে নিয়োগের উপর কোনও নজরদারি নাই, কোনও নিয়ন্ত্রণও নাই, এই পশ্চিমবঙ্গে সেই নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ঠিক কী রকম হইতে পারে, অনুমান করিতে সমস্যা হইবার কথা নহে। গত বৎসর কলিকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ এই ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে রায় দিয়া জানাইয়াছিল, চাকুরি যদি দিতেই হয়, তবে তাহা নিয়োগের নির্দিষ্ট নিয়ম মানিয়াই করিতে হইবে। সম্প্রতি আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের রায় সেই নির্দেশের বিপরীতে গেল। ডিভিশন বেঞ্চ জানাইয়াছে, যেহেতু সিভিক পুলিশের নিয়োগ মূলত ট্র্যাফিক ব্যবস্থাতেই হয়, এবং এই চাকুরি পাকা নহে, অতএব সেই নিয়োগে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নাই।

Advertisement

আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও এই রায় লইয়া কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন করা প্রয়োজন। প্রথমত, ‘স্বেচ্ছাসেবক’ শব্দটির প্রয়োগ বিষয়ে সচেতন হওয়া বিধেয়। ‘স্বেচ্ছাসেবক’ বলিতে তাঁহাদেরই বুঝায়, কোনও প্রতিদানের কামনা না করিয়াই যাঁহারা শ্রম প্রদান করিয়া থাকেন। সিভিক পুলিশ হিসাবে যাঁহারা কাজ করিতেছেন, তাঁহাদের কি সত্যই এই গোত্রে ফেলা সম্ভব? কাজটি করিলে মাসের শেষে কিছু টাকা পাওয়া যায়, ইহাই কি তাঁহাদের কাজ করিবার কারণ নহে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, পুলিশের কাজে নিয়মিত ভাবে ‘স্বেচ্ছাসেবক’-এর প্রয়োজন হইবে কেন? ট্র্যাফিক সামলাইবার কাজটির জন্য যদি বাহিনীতে যথেষ্ট কর্মী না থাকেন, তবে নূতনতর নিয়োগই বিধেয়। স্মরণে রাখা জরুরি, পুলিশের কাজে দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বিপুল। যাঁহাদের চাকুরি পাকা নহে, তাঁহাদের নিকট সেই দায়বদ্ধতার প্রত্যাশাও না থাকাই স্বাভাবিক। বিশেষত, যে পদ্ধতিতে সিভিক পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকরা চাকুরিতে নিযুক্ত হন, তাহাতে প্রার্থীর গুণাগুণ বিচারের কোনও ভূমিকা নাই। ফলে, বহু ক্ষেত্রেই এই পথটি বেনোজলের সিংহদুয়ার। বাস্তব অভিজ্ঞতাও সে কথাই বলিতেছে। সমস্ত যুক্তিই যে নিয়োগকে দলীয় আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে চিহ্নিত করিতেছে, সেই প্রথাটিকে বজায় রাখিবার যুক্তি কী, ইহা তৃতীয় প্রশ্ন। চাকুরিটি পাকা কি না, তাহা কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ কি না, তাহাতে এই প্রশ্নগুলি বদলায় না।

কথাটি শুধুমাত্র কিছু যুবকের অস্থায়ী চাকুরির নহে। জনমানসে এখনও উর্দির গুরুত্ব অসীম। সেই উর্দি স্থায়ী না অস্থায়ী, তাহাতে সেই গুরুত্বের ইতরবিশেষ হয় না। বিশেষত, যখন অস্থায়ীদের হাতেও যথেষ্ট ক্ষমতা থাকে, তখন কথাটি আরও বেশি সত্য। ফলে, সিভিক পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকরাও যথেষ্ট গুরুত্বের অধিকারী। কিন্তু, তাহার সহিত দায়িত্বের, দায়বদ্ধতার যোগ নাই। অতএব, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি সেই গুরুত্ব দলীয় স্বার্থ রক্ষার কাজেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এই রাজ্যে যাঁহারা পাকাপাকি পুলিশকর্মী, তাঁহাদের সিংহভাগের স্কন্ধেই অদৃশ্য দলীয় পতাকা থাকে। তাঁহারা যদি প্রতিনিয়ত দেখেন, তাঁহাদেরই সহকর্মী একটি গোষ্ঠী দলীয় আনুগত্যের দৌলতেই দিব্য করিয়া খাইতেছে, তাহাতে পুলিশ বাহিনীর উপকার হইবে না। সাম্প্রতিক অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা বলিতেছে, প্রথম দফার ভুলগুলি শুধরাইয়া রাজ্য প্রশাসন ঘুরিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। স্বপ্রবৃত্ত হইয়া সিভিক পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক নামক ব্যবস্থাটি বিলোপ করাই প্রশাসনের উচিত কাজ হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন