প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পক্ষে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে অংশ লওয়া এবং সেখানে ভাষণ দেওয়া কি উচিত কাজ? ইহা বিচার করিবার আগে এক বার গণতন্ত্রের প্রাথমিক সংজ্ঞাটি মনে করিয়া লওয়া যাইতে পারে। গণতন্ত্রে সকলের মত প্রকাশের অধিকার থাকাই প্রাথমিক শর্ত। সেই মৌলিক নীতিটি সঙ্ঘের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হইবার কথা, বিশেষত যখন আরএসএস এ দেশে কোনও নিষিদ্ধ সংগঠন নহে। আরএসএস-এর মতামত বিরোধীদের কাছে যতই আপত্তিকর হউক, তাহাদের নিজেদের মত প্রকাশ করিবার অধিকার আছে। প্রকৃত গণতন্ত্রে জলচল পদ্ধতি মানা যায় না।— এ কথা স্বীকার করিবার পর প্রথম প্রশ্নের উত্তরটিও সহজ হইয়া যায়। একটি স্বীকৃত সংগঠনের সভায় এক জন সম্ভ্রান্ত নাগরিক উপস্থিত হইবেন, বক্তৃতা দিবেন, আলোচনা করিবেন, ইহাতে আপত্তি করা যায় কোন যুক্তিতে? কংগ্রেস বৃথাই দ্বন্দ্বে ভুগিতেছে। তিনি কী বলিবেন, তাহা লইয়া গবেষণারও প্রয়োজন নাই। ভারতীয় রাজনীতির সম্মুখ-পরিসরে অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরিয়া আছেন প্রণববাবু। তাঁহার গভীর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি সর্বজ্ঞাত। কিন্তু তাহা না হইলেও এ বিষয়ে আপত্তির কোনও নীতিগত জায়গা থাকিত না। কোনও ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়া তাঁহার বক্তব্য পেশ করিবেন, এই পরিসরটুকু ভারতীয় রাজনীতি হইতে যেন হারাইয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করার দায় কংগ্রেসের মতো দলের উপরই ন্যস্ত।
পরবর্তী প্রশ্ন হইতে পারে, প্রণব মুখোপাধ্যায় সেখানে গিয়া যাহা বলিবেন, তাহাতে লাভ কী। সঙ্ঘ কি তাহাতে কর্ণপাত করিবে? হিন্দুত্ববাদের প্রচারকরা কি নিজেদের অবস্থান পাল্টাইয়া বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষতা লইয়া ভাবনাচিন্তা শুরু করিবে? আর যদি বক্তার কথার কোনও গুরুত্বই না থাকে, তবে কি বক্তার গুরুত্বও এই অংশগ্রহণের ফলে খাটো হইয়া যায় না? সাধ করিয়া এই অসম্মান কেন নিজের উপর ডাকিয়া আনিবেন দেশের অন্যতম বরেণ্য ও বরিষ্ঠ রাজনীতিক? কংগ্রেসের কতিপয় নেতার এই সংশয় প্রসঙ্গে মনে পড়িতে পারে, শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন ও জাপানে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত বক্তৃতাগুলির কথা। জাতীয়তাবাদে আদ্যন্ত নিষিক্ত ও গ্রস্ত দুইটি দেশের ভদ্রজনেরা রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বিরক্ত সতর্কবাণী শুনিয়া প্রভাবিত তো হন নাই-ই, তাঁহাকে লইয়া উপহাসের বান বহাইয়াছিলেন। তবু কবিবর তাঁহার কথা বলিয়াছিলেন। কেহ শুনিবে কি না, সেই সন্দেহের আগে নিজের বলিবার নৈতিকতাটিকে স্থান দিয়াছিলেন। সংলাপ তৈরির লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাইয়া যাওয়াকে জরুরি মনে করিয়াছিলেন।
ঠিক সে ভাবেই, প্রণববাবু যদি আগামী ৭ জুন সঙ্ঘের সভায় ধর্মনিরপেক্ষতার উদার নীতিগুলি নূতন করিয়া বলেন, প্রতি দিনের রাজনীতির অভিযোগ-প্রত্যভিযোগের ভাষ্য ছাড়াইয়া তাহার একটি বৃহত্তর অর্থ তৈরি হইবার কথা। সঙ্ঘের সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ কেন ও কী ভাবে ভারতীয় সভ্যতার মূলতন্তুগুলিকে আঘাত করিয়া চলিয়াছে, তাহা ব্যাখ্যা করিবার অবকাশ একটি দুর্লভ সুযোগ। সেই সুযোগ— সঙ্ঘের আদর্শ কোথায় ভুল, সঙ্ঘের মঞ্চেই দাঁড়াইয়া তাহা বলিবার সুযোগটি যে প্রণববাবু গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাতে গণতন্ত্রের সম্মান বাড়িয়াছে, কংগ্রেসের সম্মানও। সর্বোপরি, মনে রাখা ভাল, চাঁদ সদাগরের লৌহবাসরেও কিন্তু ছিদ্র ছিল। হিন্দুত্ববাদের দুর্গ যত প্রবলই হউক, তাহাতেও কি ছিদ্র নাই? সঙ্ঘবাদী যে সব মানুষ সত্যই দেশকে ভালবাসেন, সেই দেশের প্রকৃত চরিত্রটির সহিত তাঁহাদের আদর্শের সংঘাত কোথায়, বুঝাইয়া বলিলে তাঁহাদের কেহই কি বুঝিবেন না? আর এ কথা বুঝাইয়া বলিবার পক্ষে প্রণববাবুর অপেক্ষা যোগ্যতর ব্যক্তি আজ আর কয়জন!