বন্দির গণতান্ত্রিক অধিকার

প্রত্যেক কয়েদির সুরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রেরই

কাউকে যে কারণেই আটক রাখা হোক না কেন, ভারতীয় সংবিধান তাঁর চিকিৎসা পাওয়া-সহ অন্যান্য মানবিক অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলে। বস্তুত, এ বিষয়ে পরাধীন ভারতের আইনটিও (১৮৯৪) বন্দিদের জীবনের অধিকার সুরক্ষিত করার নির্দেশ দেয়।

Advertisement

সন্তোষ রাণা

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

দীর্ঘ দিন জেল বন্দি এবং অসুস্থ সুদীপ চোংদারের মৃত্যু হল। তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত গাফিলতির অভিযোগের প্রত্যুত্তরে জেল কর্তৃপক্ষের বয়ান: চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু বাঁচানো যায়নি। জেলে বন্দিরা কী ধরনের চিকিৎসা পেয়ে থাকেন, সে সম্পর্কে যাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তাঁদের কারও কাছেই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, হওয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই বলেই।

Advertisement

কাউকে যে কারণেই আটক রাখা হোক না কেন, ভারতীয় সংবিধান তাঁর চিকিৎসা পাওয়া-সহ অন্যান্য মানবিক অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলে। বস্তুত, এ বিষয়ে পরাধীন ভারতের আইনটিও (১৮৯৪) বন্দিদের জীবনের অধিকার সুরক্ষিত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু আইন লঙ্ঘনের ধারাটিও নিরবচ্ছিন্ন। এ আইন রচিত হওয়ার মাত্র ছয় বছর পর ছোটনাগপুরে উলগুলানের সংগঠক বিরসা মুন্ডা মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে মারা যান রাঁচি জেলে। কর্তৃপক্ষ রটালেন, তাঁর মৃত্যু হয়েছে কলেরায়। দেশবাসী বিশ্বাস করেননি। পরবর্তী গবেষণা থেকেও সেই রটনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিরসার মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক— মেরে না ফেললে তাঁকে বাঁচানো যেত।

দেশ স্বাধীন হল। ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানের ধারা ১৪, ১৯ ও ২১ এবং বিভিন্ন মামলায় তার ব্যাখ্যা বন্দিদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিল। কিন্তু, বিভিন্ন জেলে বন্দিদের চিকিৎসা না পাওয়াটাই যেন বিধিলিপি হয়ে রইল। ১৯৬০-এর দশকে ভারত রক্ষা আইনে আটক থাকার অভিজ্ঞতা লিখেছেন স্নেহাংশু আচার্য। তাঁর বর্ণনায়, এক জন কয়েদি দু’শিশি ওষুধ নিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকত। বন্দিরা লাইন করে দাঁড়াত। দু’ধরনের ওষুধের একটা ছিল জ্বরের, আর একটা পেটের অসুখের। কার কী হয়েছে শুনে সেই কয়েদি ডাক্তার তার মুখে ওই ওষুধের দুটো ফোঁটা ঢেলে দিত। ১৯৭০-এর দশকে জেলে থাকার সময় আমাদেরও অভিন্ন অভিজ্ঞতা। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল বা বা প্রেসিডেন্সি জেলের মতো বড় কারাগারে পাশ করা ডাক্তার ছিলেন; হাসপাতালও ছিল, কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীর দায়িত্ব পালন করতেন প্রধানত কিছু কয়েদি, যাঁদের বলা হত ‘রাইটার’। তাঁরা তাদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা মতো ওষুধপত্র দিতেন। কিছু রোগীর তাতেই নিরাময় হত, কেউ কেউ মারা যেতেন।

Advertisement

এখন সংশোধিত নাম সংশোধনাগার। কিন্তু, বন্দিদের চিকিৎসার ব্যাপারে শতাব্দীপ্রাচীন ব্যবস্থার কোনও সংশোধনের কথা জানা যায় না। এমনিতেই ভারতে এখন সংশোধনাগারগুলোতে বন্দি আছেন সাড়ে চার লক্ষ মানুষ, সংখ্যাটা যত বন্দি রাখার ব্যবস্থা আছে তার ২০ গুণ বেশি। গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুর্দশার মধ্যে থাকতে হয়। তার ওপর চিকিৎসা সংক্রান্ত অবহেলা। ক’দিন আগে এক চিকিৎসক বন্ধু বলছিলেন, অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠাটা খুব সাধারণ ঘটনা নয়, তাঁদের সুস্থ হওয়া বা বেঁচে থাকাটা নেহাত কপালের জোর! এমনকি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা মাফিয়া, গুন্ডা, যারা জেলে বসে তাদের রাজত্ব চালিয়ে যায়, তাদেরও চিকিৎসার দরকার হলে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়; এবং তখন তাদের জন্য বড় ডাক্তারবাবুদের ছুটতে হয়, বাইরের হাসপাতালে স্থানান্তরণের তদারকি চলে। কোনও কোনও সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডকে সে কারণেই হয়তো হোটেলের মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে।

কিন্তু সাধারণ বন্দি, এবং বিশেষত রাষ্ট্র যাঁদের ইউএপিএ-র মতো ধারায় অভিযুক্ত করে বন্দি রাখে, তাঁদের যে হেতু কপাল চওড়া করার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই, চিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক অধিকার বিষয়টাই তাঁদের নাগালের বাইরে। রাষ্ট্র সহজেই তার দায়িত্ব অস্বীকার করে, সাংবিধানিক নির্দেশ উল্লঙ্ঘন করে। আর রাজনৈতিক বন্দি হলে তো কথাই নেই— রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া সেই মানুষদের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের অঙ্গ হিসেবেই তাঁদের চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। রটনায় বিশ্বাস করে অথবা অন্য কোনও কারণে সামাজিক কণ্ঠস্বরগুলোও প্রায়শ প্রশ্ন করার দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। কদাচ কোনও সুপরিচিত নাম উঠে এলে কিছু কথা ওঠে, খবর হয়, কিন্তু হাজার হাজার বন্দির সুস্থ থাকার ভাগ্য অনিশ্চয়ে ঝুলে থাকে।

সুদীপ চোংদারের মৃত্যুর পর কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে এটা নাকি তাঁর কৃতকর্মের ফল, তিনি যে দলের নেতা ছিলেন, সেই দল বহু মানুষকে হত্যা করেছে, সুতরাং তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করার বা প্রতিবাদের দাবি উঠতেই পারে না। প্রথমত, বিষয়টা এক জনকে নিয়ে নয়, যে কোনও বন্দিকে নিয়েই। প্রথমত, বন্দির কৃতকর্মের ফল, অর্থাৎ শাস্তি, কী হবে তা ঠিক করে বিচারব্যবস্থা। বন্দিকে সংবিধান নির্দেশিত মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো শাস্তি বিচারব্যবস্থায় নেই। অপরাধ প্রমাণিত হলেও তা করা যায় না। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, বহু বন্দির অহেতুক, প্রায়শই বিনা অপরাধে, ফলভোগ করে চলা। যেমন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন, জাস্টিস আন্ডার ট্রায়াল: আ স্টাডি অব প্রি-ট্রায়াল ডিটেনশন ইন ইন্ডিয়া (২০১৭)-তে দেখা যাচ্ছে, মোট বন্দির দুই-তৃতীয়াংশই বিচারাধীন।

পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া সঙ্কেত এই যে, এঁদের অনেকেই দীর্ঘ কারাবাসের পর নিরপরাধ প্রমাণিত হবেন, অনেকে প্রলম্বিত বিচারের আগেই মারা যাবেন, আবার কাউকে কাউকে বিচারে দেওয়া সাজা হবে তাঁর কারাবাসের মোট সময়ের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। এই যে অপরাধ না করেও ফল ভোগ করানো— এর ক্ষতিপূরণ নিয়ে কিন্তু কোনও কথা নেই। আইন এঁদের জন্য সরকারি আইনজীবী নিয়োগ, বিচারপর্ব দ্রুত সমাধা করা ইত্যাদি যে সব ব্যবস্থার কথা বলেছে, সরকার সেগুলো মানার চেয়ে ভাঙার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। আবার বিচারাধীনদের অর্ধেকের বেশি হচ্ছেন সমাজের সুযোগবঞ্চিত অংশের— মুসলমান, দলিত ও আদিবাসী, প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিরক্ষর। তাঁদের নিয়ে কারই বা মাথাব্যথা?

অথচ, এই মাথাব্যথা ছাড়া গণতন্ত্রের অনুশীলন চলতে পারে না। সাংবিধানিক বা অন্য বিধিবদ্ধ অধিকারগুলো সীমিত, এ কথা জানা। এ বার, সেই সীমিত অধিকারগুলো থেকেও যদি বিশেষ বিশেষ মানুষকে, যেমন বন্দিদের, বঞ্চিত রাখা হয়, তা হলে বুঝতে হবে, অসুখটা গুরুতর। কেন বন্দি অবস্থায় জীবনযাত্রার মানে অসঙ্গতি থাকবে, বা অসুস্থ বন্দি চিকিৎসা পাবেন না, কিংবা জেলে মৃত্যু হলে তার কারণ নিয়ে তদন্ত হবে না, এ প্রশ্নগুলো খুবই জরুরি। জনসমাজে পরিচিত রাজনৈতিক বন্দিই হোন বা কেবল সন্দেহের বশে চোর বলে ধরে আনা লোধা আদিবাসীই হোন, প্রত্যেকের জন্য আইনি সহায়তা, মানুষের মতো বাঁচার ব্যবস্থা, চিকিৎসা এবং অন্য অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করার দাবিটাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা জরুরি কর্মসূচি করে তোলাটা আবশ্যিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন