শবরীমালা বিতর্কে আমাদের কুৎসিত মুখচ্ছবিটা বেরিয়ে পড়েছে। —ফাইল চিত্র।
বিচার বিভাগ তার দায়িত্ব পালন করেছে। সমাজের উত্তরণের পথটাকে আগলে রয়েছে যে সব প্রতিবন্ধকতা এখনও, সেগুলোর মধ্যে আরও একটাকে উপড়ে ফেলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। শবরীমালা পাহাড়ে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরের দরজা সব বয়সের নারীর জন্য খুলে যাওয়ার ক্ষণ আসন্ন। এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজের উত্তরণের পথে নিজেই বাধা আমাদের সমাজ।
ঋতুমতী নারী ঢুকতে পারবেন না আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরে— এমনই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল দশকের পর দশক। কোনও আইনি নিষেধাজ্ঞা যে নয়, তা বলাই বাহুল্য। ধর্মীয় আচারের নামে সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতার চরম নিদর্শন দাপট দেখাচ্ছিল। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সেই স্বেচ্ছাচারিতায় ইতি টেনে এক আলোকিত দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়ে দিয়েছে যখন, তখন আমাদেরই অনেকে আগলে দাঁড়াচ্ছেন সে দিগন্তে পৌঁছনোর পথ। এক বার আয়নার সামনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারব, আমাদের মুখগুলোকে কেমন দেখাচ্ছে এখন।
আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে এক শিক্ষিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’চার কথা লিখলেন। শবরীমালার মন্দিরে প্রবেশের জন্য তিনি কতটা অধীর অপেক্ষায়, তা প্রকাশ করলেন। তাতে রৈ-রৈ কাণ্ড ঘটে গেল। শিক্ষিকার বাড়ি ঘিরে ধরে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল, চলল হুমকি-শাসানি-হুঙ্কার।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ভক্ত যেতে চান ঈশ্বরের দরজায়। সামাজিক আস্তিনে লুকিয়ে থাকা বিষবাষ্পগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট পথ পরিষ্কার করার নির্দেশ দিল। কিন্তু বিষবৃক্ষটা এ বার তার সব শাখা-প্রশাখাকে সক্রিয় করে তুলে আরও দুর্গম করে তুলতে চাইল মন্দিরে পৌঁছনোর রাস্তাটা। এ প্রবণতা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর!
আমরা অনেকেই বা আমাদের অধিকাংশই অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে অভ্যস্ত। রাষ্ট্রের দিকে, প্রশাসনের দিকে, পুলিশের দিকে, বিচার বিভাগের দিকে, রাজনীতির দিকে, পড়শিদের দিকে, আরও অনেকের দিকে নানান অভিযোগের আঙুল তুলতে থাকি আমরা রোজ। কোথাও কোনও ভুল-ত্রুটি দেখলেই আমরা দায় চাপানোর লক্ষ্যবস্তু খুঁজতে শুরু করে দিই। আমাদের দিকে যাতে না আসে দায়টা, তা নিশ্চিত করতেই বোধহয় অন্যের দিকে এ ভাবে আঙুল তুলতে থাকি। আসলে আমরা প্রত্যেকে কাচের ঘরে বাস করি। দায়-দায়িত্বের ভার বহন করতে আমরা অসমর্থ। তাই অন্যের উপরে দায় চাপানোতেই আমরা স্বচ্ছন্দ। কিন্তু এইটুকু বলে থেমে গেলে আমাদের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় না। যাদের দিকে আঙুল তুলে আমরা দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করি, তারা যখন নিজেদের দায়িত্বটা যথাযথ ভঙ্গিতে পালন করেন, তখনই আমরা ঘোর আতান্তরে পড়ে যাই। আমাদের মুখোশটা খসে পড়ে, আসল মুখটা বেরিয়ে আসে। স্পষ্ট বোঝা যায়, কদর্যতা আসলে কোথায়।
আরও পড়ুন
শবরীমালায় প্রবেশের ইচ্ছা ফেসবুকে জানাতেই বিক্ষোভের মুখে শিক্ষিকা
এর আগে শবরীমালা বিতর্ক যত বারই উঠত, আমরা রাষ্ট্রের দিকে বা প্রশাসনের দিকে বা বিচার বিভাগের দিকে দায় ঠেলে দিতাম। এ বার বিচার বিভাগ স্পষ্ট অবস্থান নিল। বিতর্ক বা জটিলতা বহাল থাকার আর কোনও কারণই নেই। কিন্তু স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমরা দেখছি, আরও তীব্র ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরে ঋতুমতী নারীর প্রবেশাধিকারের বিরোধিতা। অর্থাৎ সমাজের একটা বিরাট অংশ যে মুখোশটা টেনে রেখেছিল মুখের সামনে, সেটা খসে গিয়েছে। আমাদের কুৎসিত মুখচ্ছবিটা বেরিয়ে পড়েছে।
শবরীমালা বিতর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরও এক বার প্রমাণ করল, আমরা কাচের ঘরেই থাকি। প্রমাণ করল কাচের ঘরে বসেই নিরন্তর অন্যের দিকে ঢিল ছুড়তে থামি আমরা। প্রমাণ হয়ে গেল যে, নিজেদের চার পাশে সভ্যতা, প্রগতিশীলতা এবং আধুনিকতার যে খোলসটা আমরা ধরে রাখি, তা অত্যন্ত ভঙ্গুর।