অপচয়ের রাজ্যে নতুন অবতার

এই রাজ্যেই অপচয়ের শেষ নেই। এবং অপচয়ের শুরু সরকারি স্তরে। ক্লাবের জন্য টাকা। দরাজ হাতে টাকা বিলোনো হয় উৎসবের জন্য। এ বার টাকা দেওয়া হয়েছে পুজোর জন্যও। শুধু পুজো কমিটিগুলির জন্য দশ হাজার টাকার অনুদানই নয়, এর থেকেও বেশি টাকা সরকার খরচ করছে পুজোর জন্য।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

রাজ্যে সারা ক্ষণ কেবল নেই নেই রব। রাজ্য সরকারের কর্মীদের ডিএ বাড়ে না টাকার অভাবে। ঝাঁ চকচকে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল পরিকাঠামো নিয়ে পড়ে রয়েছে, চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীর নিয়োগ হয় না টাকার অভাবে। জেলায় জেলায় বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলের ভবন সম্প্রসারণ হচ্ছে না স্রেফ টাকার অভাবে। টাকার অভাবে যে সেতুর মেরামতি হয় না তার উদাহরণ মাঝেরহাট সেতু।

Advertisement

অথচ এই রাজ্যেই অপচয়ের শেষ নেই। এবং অপচয়ের শুরু সরকারি স্তরে। ক্লাবের জন্য টাকা। দরাজ হাতে টাকা বিলোনো হয় উৎসবের জন্য। এ বার টাকা দেওয়া হয়েছে পুজোর জন্যও। শুধু পুজো কমিটিগুলির জন্য দশ হাজার টাকার অনুদানই নয়, এর থেকেও বেশি টাকা সরকার খরচ করছে পুজোর জন্য। রাস্তাঘাট মেরামত করে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা, জঞ্জালমুক্ত রাখা, দর্শনার্থীদের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার নির্মাণ করা, ইত্যাদি কাজে যদি খরচ করা হত তা হলে এই লেখারই প্রয়োজন হত না। আসলে পুজোয় করদাতাদের কাছ থেকে আদায় করা টাকার একটা বড় অংশ স্রেফ জলে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। কোন যুক্তিতে, সে প্রশ্নের জবাব রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে মিলবে না। রেড রোডে বিসর্জনের কার্নিভালে কত টাকা খরচ হয় তার হিসেব পূর্ত দফতরের কাছে চাইলে তারা বলে অর্থ দফতরের কাছে ফাইল রয়েছে। তথ্য দফতর স্বরাষ্ট্র দফতরকে দেখিয়ে দেয়, আর স্বরাষ্ট্র দফতর মুখ্যমন্ত্রীর দফতরকে।

এতেই শেষ নয়। রয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে পুরস্কারের ব্যবস্থা। বিশ্ববাংলার পুরস্কার। কলকাতার পুজো, জেলার পুজোকে পুরস্কারের ব্যবস্থা। তাতে বিচারকদের ঘুরে বেড়ানো, খাওয়াদাওয়ার তো একটা বড় খরচ আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের পুরস্কার। কলকাতা পুরসভা দেয় পুরশ্রী পুরস্কার। তার ব্যয়ভার মেটায় একটি বেসরকারি সংস্থা। এই খাতে ২৫ লক্ষ টাকা দিয়ে যে সংস্থাটি পুরসভাকে সাহায্য করে, তার বিনিময়ে পুরসভার কাছে তারা কোনও সুযোগ নেয় কি না, নাগরিকরা সে কথা জানেন না।

Advertisement

এ বার এ সবের সঙ্গে যোগ হল পুজো কমিটিগুলিকে অনুদানের জন্য ধার্য ২৮ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, পুজোয় বিদ্যুৎ নেওয়ার জন্য পুজো কমিটিগুলিকে বিদ্যুৎ বিলে শতকরা ২৩ ভাগ ছাড় দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় ছাড়ের টাকাটা পুষিয়ে নেওয়ার অন্য ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু জেলায় সব দায়ভারই গিয়ে পড়েছে রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমের উপরে, অর্থাভাব যার নিত্যসঙ্গী। বিদ্যুতের সারচার্জে ছাড় দেওয়ায় তাদের কতটা ক্ষতি হবে সেই হিসেব এখনও স্পষ্ট নয়। এক একটা পুজোয় যখন এক কোটি টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে, তখন তাদের জন্য এত ছাড় কেন?

কলকাতা শহরে এখন এমন কোনও পুজো কমিটি খুঁজে পাওয়া ভার যার সভাপতি বা চেয়ারম্যান কোনও নেতা-মন্ত্রী নন। যত বড় নেতা, তাঁর পুজোয় জাঁকজমক তত বেশি। কলকাতা শহরে এখন অন্তত ৪০টি পুজো রয়েছে যাদের বাজেট ৫০ লক্ষ টাকার উপরে। কোটি টাকা খরচ করে এমন পুজোর সংখ্যা কম করে ১০টি। যেখানে ৬-৭ লক্ষ টাকার মধ্যে পুজো করে কেউ কেউ পুরস্কার জিতে যাচ্ছে, সেখানে একটা পুজো করতে প্রায় কোটি টাকা কী ভাবে খরচ হয়, প্রবীণ শিল্পীদের অনেকেই সে প্রশ্ন তোলেন। দক্ষিণ শহরতলিতে এমন পুজোর কথা জানি যাদের ঠাকুর, মণ্ডপ, আলো মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। আরও ৫০ হাজার টাকা ধরা ছিল পুজো, ভোগের জন্য।

দক্ষিণ কলকাতার এমনই একটি ৫০ লাখি পুজোর কমিটির এক প্রবীণ সদস্যের আক্ষেপ, ‘‘আমরা বছর কুড়ি আগেও পুজোয় টেনেটুনে লাখ টাকা খরচ করতাম। পুজো করে একটা অংশ মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করতাম, কিংবা গরিব মানুষকে কাপড়-কম্বল দিতাম। এখন বাজেট অনেকটা বেড়েছে, এত টাকা কোথায় যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে না।’’ উত্তরের এক সুপারহিট পুজোর এক প্রাক্তন সম্পাদকের কথায়, ‘‘আমরা যারা রাতের পর রাত পুজোর জন্য জেগে কাটাতাম, পকেট থেকে খরচ করতাম, এখনকার পুজো কমিটি তাদের পাত্তাই দেয় না। মন্ত্রী এখন চেয়ারম্যান। বিধায়ক সম্পাদক। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথায় সেই টাকা যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় খরচের বহর দেখে দুঃখ পাই, কিন্তু বলব কাকে?’’

শিল্পের প্রতি মনোযোগটাও যেন হারিয়ে গিয়েছে অনেকাংশেই। কলকাতায় এক সময় তাঁর তৈরি মণ্ডপ দেখতে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেই শিল্পী এখন অনেকটাই আড়ালে। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘তখন এক শিল্পীর কাজ দেখতে অন্য শিল্পীরা দল বেঁধে যেতেন। মতামত দিতেন। সে সব এখন আর হয় না।’’ ২০০০ থেকে ২০১০, এই দশ বছরে একাধিক নামকরা পুজোয় লোক-টানা এক শিল্পীর কথায়, ‘‘এমন সব থিম হচ্ছে যা মানুষের মাথায় ঢুকছে না। আবার অনেকে পুরনো কাজকেই একটু অদলবদল করে বেচে দিচ্ছেন পুজোর বাজারে। এই সে দিনকার সাত-আট লক্ষ টাকার থিম পুজো কমিটির কাছে বেচা হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষে।’’

সত্যিকারের পুজো-পাগলরা সাইডলাইনের বাইরে। প্রতিমা, মণ্ডপও গৌণ। চোখঝলসানো আলো, দশ দিন ধরে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে পাড়ার লোকের ঘুম তাড়ানো আর বাড়ির বারান্দা-জানালার সামনে হোর্ডিংয়ের ব্যারিকেড তুলে দেওয়াটাই পুজো। মাথায় স্থানীয় নেতারা। সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানাবেন কোথায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন