সোশ্যাল মিডিয়া বা জনমাধ্যম আরও এক বার আমাদের চোখের সামনে আয়না হয়ে দাঁড়াল। সে আয়নায় নিজেদের যে ছবি ফুটে উঠছে অনবরত, তাতে আঁতকে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। এত বিষ,
এত বিদ্বেষ, এত হিংসা জমা করে রেখেছি মনের মধ্যে, একটা উপলক্ষ পাওয়ামাত্র গলগল করে বেরিয়ে আসছে লাভাস্রোত। আপাতত সে উপলক্ষের নাম পুলওয়ামা।
‘উপলক্ষ’ শব্দটা ব্যবহার করা মানে পুলওয়ামার ঘটনাকে ছোট করা নয়। এ রকম ঘটলে দেশবাসী সংক্ষুব্ধ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই উচিত। এ রকম ঘটনা কেন আটকানো যাচ্ছে না? দায় কার? ‘জোশ’-এর এত ফোয়ারা তবে কিসের জন্য? কী হতে পারে প্রতিবিধান? এই সব কিছুই নাগরিক সমাজের চর্চায় উঠে আসার কথা। আসেনি, এমনও নয়। কিন্তু সে সব ভাসিয়ে দিয়ে উপচে পড়েছে ‘যুদ্ধ চাই’ জিগির আর সেই জিগিরের বিন্দুমাত্র বিরোধী স্বর দেখলেই টুঁটি টিপে ধরার প্রয়াস। সীমান্তে যুদ্ধ ঘোষণা হয়নি, কিন্তু অঘোষিত গৃহযুদ্ধে নেমে পড়তে আমরা দেরি করিনি। সেখানে পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করার ডাক আছে, কাশ্মীরিদের বয়কট করার ঘোষণা আছে, তাঁদের মারধর করা আছে এবং ‘দেশদ্রোহী’ শায়েস্তা করার অভিযান আছে!
হ্যাঁ, পুলওয়ামার মর্মান্তিক ঘটনাকে লোক খেপানোর একটি ‘উপলক্ষ’য় পরিণত করেছি আমরাই। সেই সঙ্গে দেশের আত্মাকে চূড়ান্ত অবমাননা করার নাম দিয়েছি দেশপ্রেম।
একটু চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা সম্ভব, এই খেপামির জমিটা আসলে বেশ কিছু দিন ধরেই সার-জল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছিল। কোথাও গো-রক্ষা, কোথাও লাভ জেহাদ, কোথাও ছেলেধরা, কোথাও নাগরিকত্ব বিল, কোথাও বা মন্দির-মসজিদ। গোরক্ষকদের দাপাদাপি যে সব রাজ্যে সবচেয়ে বেশি, ছেলেধরা গুজবে গণপ্রহারের ঘটনা অনেক বেশি তীব্রতা পেয়েছিল তার বাইরে— উত্তর-পূর্বে, দক্ষিণে। অর্থাৎ অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা দাওয়াই। যেটা যেখানে খেটে যায়! পশ্চিমবঙ্গে যেমন ‘দেশভক্ত’দের সঙ্গে ছেলেধরার গুজবও প্রবল। জায়গায় জায়গায় মোবাইলে ঘুরছে জুজু— কারা নাকি বাড়ি বয়ে এসে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে যাচ্ছে! ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই হল কি হল না, বসে যাচ্ছে গণধোলাইয়ের আসর। কারণ, মনটা খেপার জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। এ সব আগেও ঘটত। খুবই ঘটত। কিন্তু এত পরিব্যাপ্ত ভাবে, এত ছুতোয় এত সংগঠিত আক্রমণ এত দীর্ঘ সময় ধরে লাগাতার— কমই হয়েছে। কারণ আক্রমণের চরিত্র এবং পরিধিতে এখন ডিজিটাল বিপ্লব। গণমানসের গলিঘুঁজি বুঝতে গেলে সাবেক আমলের উদাহরণ অনেকাংশে অকার্যকর।
একটা নমুনা দিই। অসম থেকে তামিলনাড়ু, ছেলেধরার আতঙ্ক ছড়াতে যে ভিডিয়োটি হাতে হাতে ঘুরেছে, সেটি শিশু চুরি সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরির কাজে পাকিস্তানের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নির্মাণ। তার ল্যাজা-মুড়ো ছেঁটে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে। ২০১৭-১৮ জুড়ে তার জেরে অন্তত ৬৯টি গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে, মারা গিয়েছেন কম করে ৩৩ জন। এই ৩৩টি প্রাণ পাকিস্তান নেয়নি, জঙ্গিরা নেয়নি, তথাকথিত ‘পাকপ্রেমী দেশদ্রোহী’রাও নেননি। নিয়েছি আমি-আপনি, দেশের কথা ভেবে যাঁদের রাতে ঘুম নেই!
সস্তায় মোবাইল, প্রায় নিখরচায় ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত, সংগঠিত ট্রোল বাহিনী— দারিদ্র অশিক্ষা বৈষম্য বহুত্ব কুরাজনীতির দেশে এর থেকে বিপজ্জনক ‘কম্বো প্যাক’ বোধ করি আর নেই। কচু কাটতে কাটতে ডাকাত হয়। ভার্চুয়াল হানাহানি দেওয়াল থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে। গুগল-এর হিসেব বলছে, ২০১৪ সালে এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি ৪০ লক্ষ। ২০১৮-য় সেটা ৫০ কোটি ছুঁয়েছে। ফেসবুকে আছেন ২৪ কোটি ১০ লক্ষ (আমেরিকায় ২৪ কোটি), মাসিক ভিত্তিতে হোয়াটসঅ্যাপে সক্রিয় ২০ কোটি। এক সময়ে বলা হত, ডিজিটাল সাক্ষরতাই দেশে অশিক্ষার সমস্যা অনেকাংশে ঘুচিয়ে দেবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অশিক্ষা, অল্প শিক্ষা, আর অর্ধশিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তির গুরুপাক, ভুল খবর-ভুয়ো খবর-বিকৃত খবরের ঢালাও আবাদ সামাজিক সুস্থিতিকে তছনছ করে দিচ্ছে।
আগে গুজব ছড়াত লোকমুখে। অমুক এটা শুনেছে, তমুক ওটা দেখেছে-ই ছিল তার ভিত্তি। এখন কম্পিউটার-মুদ্রিত অক্ষর, সঙ্গে অডিয়ো-ভিসুয়াল উপাদান গুজবকে হাতে গরম ‘প্রমাণ’-এ বদলে দিচ্ছে। ‘অমুক মন্দিরে নাগমাতার লীলা’ থেকে শুরু করে ‘এঁকে দেখুন, ইনি ফুটপাতে পড়াশোনা করে এখন হেড আপিসের বড়বাবু’ মার্কা আপাতনিরীহ বার্তা থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ভুয়োর সঙ্গে ঘর করার অভ্যেস। তাকে সত্যি বলে ধরে নেওয়ার অভ্যাস। এর পর প্রকৃতই ‘বিপজ্জনক’ চারটি যখন ছিপে ছাড়া হচ্ছে, কপ করে গিলে নিতে সময় লাগছে না। ফেসবুকের চুটকিপ্রেমী গ্রুপ যে ভাবে রে রে করে মাঠে নামল সম্প্রতি, তাতে এই গতিপথটি পরিষ্কার।
তথাকথিত শিক্ষিত সমাজও কি এর বাইরে? উগ্র দেশভক্তি আর মেরুকরণের ঝান্ডাধারীদের মধ্যে তাঁরাও আছেন বড় সংখ্যায়। রাষ্ট্র, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বহুত্ববাদ, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এঁদের অনেকেরই ধ্যানধারণা একপেশে এবং মোটা দাগের। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় গলদ কি না, ভাবার সময় এসেছে। মানবিকীবিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞানের কিছু অতি জরুরি পাঠ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে পড়ুয়াদের বড় অংশই। অথচ তাঁরাই পরে গুগল সম্বল করে জনমাধ্যমে ইতিহাস, রাজনীতির বিশ্লেষক হয়ে উঠছেন। তথ্যকে তার নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে বিচার করা এবং কোন তথ্য কে কেন কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইছেন, সেই রাজনীতি বোঝার জন্য, এমনকি ইতিহাসকে পড়ার জন্যও নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। সেটা যে হাতের মোয়া নয়, বোঝাবে কে!
পাশাপাশি আর একটা ঘটনাও ঘটেছে। কিছু দিন আগে অবধিও সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার বিপদের কথা বিদ্বৎসমাজ মনে করাতেন বার বার। জনমাধ্যম এসে সুপ্তির আড়ালটা উধাও। কারণ জনমাধ্যমের গণতন্ত্রে সবাই কেউকেটা, সবাই স্পেশাল। তার মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাম্য যেমন আছে, তেমনই আছে নিজেকে স্বরাট বলে জ্ঞান করার অদম্য হাতছানি। সামাজিকতার বেড়িগুলো সেখানে অনেক আলগা। জনমাধ্যমে তাই খুব সহজেই গালাগাল দেওয়া চলে। চক্ষুলজ্জায় পড়তে হয় না। আরও অনেক লক্ষ্মণরেখাই আবছা হয়ে যায়। স্থানকালপাত্রের বিচার তার অন্যতম। মানুষ এমনিতে যে কথা ঘরের মধ্যে বলে, সে কথা ঠিক সে ভাবে চায়ের দোকানে বলে না। চায়ের দোকানে যা বলে, সভাসমিতিতে বলে না। ‘এ ভাবে বলতে নেই’-এর একটা মূল্যবোধ তার মধ্যে কাজ করে, অন্তত দীর্ঘদিন করেছে। যার সঙ্গে কথা বলছে, তার বয়স, অবস্থান, পছন্দ-অপছন্দের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করেছে। কোনও কথা পছন্দ না হলেই তেড়ে ঝগড়া করেনি। অনেক সময় শ্রোতার মুখ চেয়ে ‘তা বটে, ওই আর কী’ বলে চুপ করেছে। এগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত সহজ সামাজিকতারই অঙ্গ ছিল। আজ যে জনমাধ্যমে সুস্থ সংলাপের পরিবেশ গড়ে তোলা যাচ্ছেই না, তার একটা বড় কারণ এই সহজ কথালাপের অভ্যেসটি হারিয়ে যাওয়ার মুখে। চারটে মানুষ এক জায়গায় হলে আজকাল যে যার ফোন ঘাঁটতে ব্যস্ত থাকে। জনমাধ্যমই তার পাড়ার রক, সেটাই চায়ের দোকান, সেটাই জনসভা। শুধু ভাষাটা তদনুযায়ী বদলে নিতে হচ্ছে না, সেটা একই থেকে যাচ্ছে সবচেয়ে নগ্ন, উগ্র আর আগ্রাসী চেহারা নিয়ে।
লক্ষ করার বিষয় এই, এক দিকে জনমাধ্যম যেমন ব্যক্তিবাদের উদ্যাপন, আবার সে-ই উদ্যাপন-উন্মুখ ব্যক্তিকে সুযোগ দিচ্ছে সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। এই সমষ্টি দু’টি স্তরের। প্রথমত আমি নিজেকে মেলেই ধরছি এক সমষ্টির সামনে। দ্বিতীয়ত আমি চাইলে যোগ দিতে পারছি বিভিন্ন গ্রুপ আর কমিউনিটিতে। ফলে জনমাধ্যমেও তৈরি হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব পরিমণ্ডল। এ বার কী ধরনের বার্তা কোন পরিমণ্ডলে ঘুরপাক খাচ্ছে বা খেতে দেওয়া হচ্ছে, সংগঠিত আক্রমণের সেও এক ছক। গোসন্ত্রাসের ভিডিয়ো সংখ্যাগুরু এলাকায় যে কাজে লাগবে, সংখ্যালঘুর পাড়ায় সেটাই ঠিক অন্য কাজ করবে। বাড়িতে চড়াও হয়ে কিডনি কেটে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক কর্পোরেট জগতে ছড়ানো হবে না। সেখানে পাতে পড়বে নানা ‘পরিসংখ্যান’, বাছা বাছা কেষ্টবিষ্টুর বক্তৃতা, রাষ্ট্রগৌরবের ফটোশপ।
শুধু একটা জায়গায় স্যুটবুট আর রামা কৈবর্তে তফাত নেই— সকলেরই নিজের পরিমণ্ডলের প্রতি অগাধ আস্থা। আমার পরিচিতগোষ্ঠীই ঠিক বলছে, এই বিশ্বাস। আর এটাই বিদ্বেষ আর ঘৃণার রাজনীতির সবচেয়ে বড় পুঁজি।
‘সুবর্ণরেখা’ ছবির শেষ পর্বে পর্দা জুড়ে ফুটে উঠত: এ রাত্রিরও শেষ আছে...। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চেয়েও বেশি মনে পড়ছে রমাপদ চৌধুরীর গল্প। গেঁয়ো স্টেশনে সাহেবদের ট্রেন থামাটা এক দিন বন্ধ হল। কিন্তু গোটা গ্রামটা চিরতরে ভিখিরি হয়ে গেল। বিষ ছড়াতে ছড়াতে যাওয়া আজকের ট্রেনও হয়তো বন্ধ হবে কখনও। কিন্তু ‘ভারতবর্ষে’ আমরা তত দিনে ঠ্যাঙাড়ে হয়ে যাব ঠিক!